শুক্রবার, ২২ জুন, ২০১২

বাজেট : সেদিন এদিন ও আগামী দিন


॥ এরশাদ মজুমদার 


পঞ্চাশ বছর ধরে আমি বাজেট রিপোর্টিং করছি। চলমান বাজেটব্যবস্থাকে আমি কখনো সমর্থন করিনি। চলমান বাজেট প্রণয়ন ও ব্যবস্থাপনায় সাধারণ মানুষের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হবে না। যদি হতো পাকিস্তানের ২৩ বছর আর বাংলাদেশের ৪০ বছরেই হতো। আমাদের বাজেটের কোনো ধরনের নৈতিক বা আদর্শগত দর্শন নেই। এ ধরনের বাজেট তৈরি করতে কোনো ধরনের ওস্তাদ বা এক্সপার্টের প্রয়োজন নেই। আমাদের দাদা-নানারা নিজেদের সংসার, জমিজিরাত ব্যবস্থাপনার জন্য যে প্রাকৃতিক জ্ঞান রাখতেন সে জ্ঞানও আমাদের বাজেটপ্রণেতাদের নেই। এমনও হতে পারে যে, তারা সেভাবে ভাবেন না। যেভাবে তারা বা আমি লেখাপড়া করেছি তাতে সাধারণ মানুষের কল্যাণ ও উন্নতি নিয়ে ভাবার কোনো উপায় নেই। দেং জিয়াও, মাহাথির, লি কুয়াং যা পারেন তা আমাদের নেতারা পারছেন না কেন? আমাদের নেতা, আমলা ও অর্থনীতিবিদদের কি সে রকম লেখাপড়া নেই? বর্তমানে বাজেট তৈরি করতে নাকি সরকারকে গলদঘর্ম হতে হয়। আমলারা নাকি রাতের ঘুম হারাম করে বাজেট তৈরি করেন। কিন্তু বাজেট যখন প্রকাশ করা হয় তখন দেখি এতে নতুন কিছুই নেই। পুরনো অঙ্কগুলোকে ১০, ১৫, ২০ পারসেন্ট বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
বাজেট তৈরি করা শুরুর আগে সরকার ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিকসহ আরো অনেক তদবির মহলের সাথে মতবিনিময় করেন। সব মহলেরই তদবির বা লবি করার মতো শক্তিশালী সংগঠন আছে। তাদের কথা সরকারকে শুনতে হয়। সাংবাদিক বুদ্ধিজীবীদের কথা শুনতে হয়, তা না হলে তারা হাউকাউ লাগিয়ে দেবেন। সামরিক নেতারা মতায় এসে সব সময় বলেন, সাংবাদিকেরা আমার সংসদ। তাদের সাথে কথা বলা মানে জনগণের সাথে কথা বলা। শাইখ সিরাজ বাজেটের আগে কৃষকদের কথা বলার রেওয়াজ শুরু করেছিলেন তার ফলাফল কী তা দেশবাসী জানে না। শাইখ সিরাজের চেষ্টা এবং উদ্যোগকে আমি ধন্যবাদ জানাই। তবুও তিনি একটা ধারণা তৈরি করেছেন যে বাজেটের আগে কৃষকদের সাথে কথা বলা দরকার। ’৭২ সালের কথা বলছি। লোহানী ভাই তখন বাংলাদেশ বেতারে। সদ্য স্বাধীন দেশ, তাই এর অর্থনীতি নিয়ে কিছু আশা-ভরসার কথা লিখতে অনুরোধ করলেন। কয়েকটা লেখা লিখেছিলাম। যার জন্য আমি কোনো টাকা নিইনি। কিন্তু লেখা বন্ধ করলাম কেন? শব্দ ব্যবহার নিয়ে আমার সাথে কর্তাব্যক্তিদের দ্বিমত হলো। কৃষক শব্দ ব্যবহার করা যাবে না। বলতে হবে চাষি বা চাষাভূষা। এমন আরো বহু শব্দ ছিল। পাকিস্তান আমলে রেডিও ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে। রেডিওর ভাষা ব্যবহারের রীতি ও নীতি নির্ধারিত হতো ইসলামাবাদে। বাংলাদেশ হওয়ার পরও ইসলামাবাদের ভূতটা চট করে পালিয়ে যায়নি। চলমান বাজেট ১৬ কোটি মানুষের নামে তৈরি হলেও এটা মূলত মাত্র কিছু মানুষের জন্য, যারা রাষ্ট্রের বন্ধু এবং রাষ্ট্রের তহবিলের সদস্য। রাষ্ট্র একজন পুলিশ বা চৌকিদারের যে যতœ নেয় তেমন যতœ কোনো নাগরিকের নেয়া হয় না। ৬৩ বছরেও যাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি তারা ধরে নিয়েছেন বা মেনে নিয়েছেন আল্লাহ তায়ালাই তাদের এমন করে তৈরি করেছেন। পরম করুণাময় আল্লাহর বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে অভিমান করে একদিন এই জগৎ ত্যাগ করে। যে রাষ্ট্র স্বাধীনতা, মানবাধিকার, মৌলিক অধিকারের নামে কোটি কোটি মানুষকে যুগের পর যুগ শোষণ করে সে রাষ্ট্র কখনোই একটি কল্যাণমুখী রাষ্ট্র নয়। খাদ্য, শিা, বাসস্থান ও চিকিৎসা হলো যেকোনো মানুষের খোদা প্রদত্ত মৌলিক অধিকার। এ অধিকার কোনো রাষ্ট্র বা শাসক খর্ব করতে পারে না। যারা এ অধিকার খর্ব করে তারা হলো স্বেচ্ছাচারী ডিক্টেটর অথবা অযোগ্য। তাদের মুখোশ গণতন্ত্র হোক আর সমাজতন্ত্র হোক। তারা নমরুদ ফেরাউন আর সাদ্দাদের বংশধর।
১৯৭১ সালে যে স্লোগান দিয়ে বা যে আশা দিয়ে নেতারা স্বাধীনতার কথা বলেছিলেন, সেই আশা আজো বাস্তবায়িত হয়নি। রাষ্ট্র জনগণের কাছে যে ওয়াদা করেছে তা বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে। আমি বলব, রাষ্ট্রের দর্শন গণমুখী নয়। নেতারা জানে না একটি গণকল্যাণমুখী রাষ্ট্র কিভাবে প্রতিষ্ঠা করতে হয়। অথবা তারা জেনেও জনগণকে ধোঁকা দিয়েছেন। মাহাথির, লি কুয়াং যদি পেরে থাকেন তাহলে আমাদের নেতারা পারেন না কেন? অনেকেই বলেন, জিয়া সাহেব বেঁচে থাকলে হয়তো তিনি পারতেন। জিয়া সাহেবের একটি স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে মর্যাদার আসনে বসানোর জন্য। কিন্তু তাকে সে সময় দেয়নি দেশের শত্রুরা। অনেকেই বলবেন, আমি বঙ্গবন্ধুর কথা বলছি না কেন? গাফ্ফার চৌধুরী সাহেব তো বঙ্গন্ধুকে রাখাল রাজা বলেছেন। তিনি মানুষকে ভালোবাসতেন, এ ব্যাপারে কারো সন্দেহ থাকা উচিত নয়। কিন্তু জনকল্যাণমুখী সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তিনি নিজে কোনো ভাবনা বা পরিকল্পনা আমাদের সামনে রেখে যেতে পারেননি। তিনি সব সময় আবেগ আবিষ্ট ছিলেন। তিনি আমলাদের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। সমাজতন্ত্র সম্পর্কে তার সুস্পষ্ট কোনো ধারণা ছিল না। পরে আমলারা রাতারাতি সমাজতন্ত্রী হয়ে গেলেন। তারাই বিপ্লবের সৈনিক হয়ে গেলেন। শ্রদ্ধেয় মনি বাবুর দল ও আমলারা দল পাকিয়ে বঙ্গবন্ধুকে একদলীয় শাসন বাকশাল কায়েম করতে বাধ্য করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল, কিন্তু তিনি জানতেন না কিভাবে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করবেন। কিছু আমলা এখনো বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনাকে ঘিরে রেখেছে। সোজা কথায় বলতে গেলে দৃশ্যমান ভারতপন্থী কিছু লোক ও অদৃশ্য আরো কিছু লোক হাসিনার নামে বাংলাদেশ চালাচ্ছে। এমনটিই এখন লোকে ভাবে। আমার তো মনে হয় প্রধানমন্ত্রী ও তার দলের লোকেরা মনে করেন, আমরা মতায় থাকব, দেশ কে চালায় সেটা বড় কথা নয়। দেশ চললেই হলো। এমন চলাতে দেশের সাধারণ মানুষের কোনো উন্নতি হয় না। ফলে তাদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয় না। বাংলাদেশও তেমনি একটি দেশ। যেখানে কিছু লোক দেশ চালায় আর তারা এবং তাদের বন্ধুরাই দেশটাকে লুটেপুটে খায়। এবারের বাজেটের ১৭.২ শতাংশ খরচ হয়ে যাবে পুরনো ঋণের সুদ শোধ করতেই। এর মানে সরকার ১৬ কোটি মানুষ আর রাষ্ট্রটা দেখিয়ে বিদেশ ও স্বদেশ থেকে যে ঋণ নিয়েছেন সেই ঋণের সুদ শোধ করতে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা চলে যাবে। সরকারের চলতি খরচ চালাতে মানে কর্মচারীর বেতন, গাড়ি-বাড়িতেই খরচ হবে এক লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা। উন্নয়নের জন্য রাখা হয়েছে মাত্র ৫৬ হাজার চার শ’ কোটি টাকা। বাজে খরচ যাকে ইংরেজিতে বলে মিসলেনিয়াস আছে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি, আনসার ও র‌্যাবের জন্য রয়েছে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা। কৃষি খাতের চলমান ব্যয়ের জন্য বরাদ্দ রয়েছে পাঁচ হাজার কোটি টাকার মতো। উন্নয়ন বাজেটের মধ্যেও বাজে খরচ (অন্যান্য) রয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা। এই বাজেটে ৫০ হাজার কোটি টাকার ওপরে কর্জ নেয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এক লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকার বাজেটের জন্য ৫০ হাজার কোটি টাকা ধার করতে হবে। সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, গাড়ি-বাড়ি, পেনশন ও অন্যান্য খাতে ব্যয় করতে হবে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা। এর মানে ধার করে কর্মচারীর বেতন দেয়া। আগেই বলেছি, সরকার চালাতেই যদি বেশি টাকা খরচ হয় উন্নয়নের জন্য টাকা আসবে কোত্থেকে? আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এখন বেশির ভাগ সময় কাটে ভিআইপিদের নিরাপত্তা দিতে। এরপর যেটুকু সময় থাকে তা ব্যয় করতে হয় বিরোধী দলকে ঠেঙ্গাতে। গত কয়েক মাসে পুলিশ এবং র‌্যাবের বিরুদ্ধে যেসব খবর বেরিয়েছে তাতে এসব বাহিনীর ওপর দেশের মানুষের আর কোনো আস্থা নেই। আদালতে বিচারের জন্য গেলে পুলিশ ধরে নিয়ে ধর্ষণ করে। বিচারককে কনস্টেবল পেটায়। অনেকে হয়তো বলবেন, এ রকম ঘটনা আরো ঘটে। র‌্যাবের এক বড় সাহেব তো পীরের দরবারের অর্থসম্পদ লুট করে এখন জেলে আছেন। অপর দিকে ভারত সীমান্তে প্রতিদিন বাংলাদেশীদের হত্যা করা হচ্ছে। বিদেশীরাও এখন এর প্রতিবাদ করছেন। কিন্তু আমাদের সরকার গভীর বন্ধুত্বের কারণে আর চুলজ্জায় মুখ খুলে কিছু বলতে পারছেন না। রাষ্ট্র থাকলে একটা সরকার লাগে। আর সরকার থাকলে তার পুলিশ, মিলিটারি, র‌্যাব, আনসারসহ নানা রকমের গোয়েন্দা বাহিনী লাগে। সর্বোপরি থাকে একটা বিরাট আমলা বাহিনী। সরকার মানে তো ৩৩০ জন এমপি আর ৫০-৬০ জন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী। তারা দেশের জন্য কী কাজ করেন তা আমরা সহজে বুঝতে পারি না। কিন্তু মুখ খুললেই দেখি বিরোধী দলের বিরুদ্ধে খিস্তিখেউড় করছেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রী নিজেও সারা দিন বিরোধী দলের বিরুদ্ধে লেগে থাকেন। সরকারি দল এবং প্রধানমন্ত্রীর কথা শুনে মনে হয় বিরোধী দলের কাজ হচ্ছে সরকারি দলকে সমর্থন করা। এই একই মানসিকতা থেকেই বঙ্গবন্ধু একদলীয় শাসনব্যবস্থা বাকশাল চালু করেছিলেন। বর্তমান আওয়ামী লীগ এখন আর বঙ্গবন্ধুর একদলীয় শাসন আদর্শে বিশ্বাস করে না।
প্রস্তাবিত বাজেটকে সরকারি দল ছাড়া কেউই সমর্থন করেননি। এমনকি সরকার সমর্থক বা আওয়ামী ঘরানার অর্থনীতিবিদেরাও এই বাজেটকে সমর্থন করেননি। ১/১১-এর কেয়ারটেকার সরকারের দুই নেতা জেনারেল মইন আর ফখরুদ্দীন (যারা নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন) ছাড়া বাকি সবাই নামের সাথে তকমা লাগিয়ে চার দিকে ঘুরে বেড়াচ্ছেন এবং নানা বিষয়ে দেশবাসীকে পরামর্শ দিচ্ছেন। তেমনি একজন মানুষ হচ্ছেন মির্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি নিয়মিত সেমিনারে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াচ্ছেন। এসব ভদ্রলোকই ওই সময়ে দেশের বিরাট তি করেছেন। জনসাধারণ তাদের কথা ভুলে গেছেন। তারাও বেহায়ার মতো কথা বলে চলেছেন। কই একজনও তো এ কথা বলেননি যে, সে সময়ে তারা বাধ্য হয়ে মন্দ কাজগুলো করেছেন বা মন্দ কাজের জন্য জাতির কাছে মাও চাননি। মির্জ্জা আজিজও বলেছেন, বিগত বছরের প্রায় সব ইকোনমিক ইন্ডিকেটরই নেগেটিভ। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমেছে, ডলার এক্সচেঞ্জ রেটও ১১ ভাগ কমেছে। প্রায় সব েেত্রই প্রবৃদ্ধি ও অগ্রগতি পেছন দিকে ছুটছে। তবুও আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলে চলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকার অনেক কাজ করেছেন যা সাংবাদিক ও বিরোধী দল দেখতে পায় না। সরকারি হিসাব এবং পরিসংখ্যানই বলেছে প্রবৃদ্ধি অনেক েেত্র নেগেটিভ। মির্জা সাহেব তার লেখায় বিষয়টা বিস্তারিতভাবে খোলাসা করেছেন। সিপিডিসহ আরো অনেক সংগঠন বলেছে বাজেট অবাস্তব। প্রধানমন্ত্রী তো বলেছেন তার ভালো কাজগুলো বিরোধী দল নষ্ট করে দেয়। তিনি গাছ লাগালে বিরোধী দল ফল খায়। আমি আমার লেখায় বহুবার বলেছি, কোনো রাজনৈতিক সরকার মতায় না থাকলেও প্রবৃদ্ধি হয়। প্রশ্ন তা কী রকম প্রবৃদ্ধি? বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হওয়া দরকার গড়ে ১০ শতাংশ। কিন্তু কোনো সরকারই এ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারেনি। যখন অরাজনৈতিক সরকার মতায় থাকে তখনো প্রবৃদ্ধি ৪-৫ শতাংশ হয়। এর মানে হচ্ছে সরকারি উদ্যোগ না থাকলেও জনগণের চেষ্টায় অর্থনীতির চাকা চলতে থাকে। ফলে কিছুটা প্রবৃদ্ধি একেবারে থেমে যায় না। ক’দিন আগে সৈয়দ আশরাফ বলেছেন আওয়ামী লীগকে আরো দুইবার নির্বাচিত করার জন্য। তাহলে তারা বাংলাদেশকে মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের মতো করে দেবেন। সৈয়দ সাহেবকে বলব, আপনি একজন মাহাথির ও একজন লি কুয়াং এনে দিন। বলুন বাংলাদেশে লি কুয়াং বা মাহাথির কে? বঙ্গবন্ধু এ কাজটি হয়তো পারতেন। বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য তিনি পারেননি। তিনি নিজেই বলেছেন, তার চার দিকে চাটার দল। তিনি বিদেশ থেকে যা আনেন চাটার দল সব খেয়ে ফেলে। তিনি আরো বলেছেন, সাত কোটি কম্বল রিলিফ এসেছিল কিন্তু তিনি তো পাননি। তাহলে তার ভাগেরটা কোথায় গেল? আমি নিশ্চিতভাবেই বলব, তার স্বপ্ন ছিল সোনার বাংলা গড়ার, কিন্তু অ্যাবিলিটি ছিল না। ফলে তার আমলেই দেশে দুর্ভি হয়েছিল এবং লাখ লাখ মানুষ না খেয়ে মারা গেছে। সে সময়ে গরিবের খাদ্য লুট করে বহু মানুষ ধনী হয়েছে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায়। তিনি দেশ ও দেশের মানুষকে ভালোবাসতেন এ ব্যাপারে কারো কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়। কিন্তু একজন প্রেমিক কখনোই উত্তম শাসক হতে পারেন না। বঙ্গবন্ধুকে পা ধরে সালাম করেই অনেকের কপাল খুলে গেছে। তিনি ভেবেছিলেন একদলীয় গণতন্ত্র চালু করলেই তিনি জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তন করতে পারবেন। এর মানে তিনি তখন সমালোচনা সহ্য করতে পারছিলেন না। তিনি না বুঝেই সমাজতন্ত্র চালু করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি নিজে যা ভালো মনে করেছিলেন তাই করেছেন। তিনি খবরের কাগজ বন্ধ করেছিলেন। তিনি সরকারি কর্মচারীদের রাজনীতিতে জড়িত করেছিলেন। তিনি যখন সমাজতন্ত্র চালু করার চেষ্টা করেছিলেন তখন সমাজতন্ত্রের মরণদশা। এখন তো চীন, রাশিয়াতেই সমাজতন্ত্র নেই।
গত ৪০ বছরে রাজনৈতিক নেতা ও তাদের বন্ধুরাই বিত্তবান হয়েছেন বাংলাদেশে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, দেশের মানুষের ক্রয়মতা বেড়েছে। কথাটা সত্যি। ’৭০ সালে যার দুই টাকা দিনমজুরি ছিল সে পাচ্ছে তিন শ’ থেকে চার শ’ টাকা। পরিবারের সদস্য সংখ্যা পাঁচ-ছয়জন। বৃদ্ধ মা-বাপ থাকলে তাদেরও দেখতে হয়। গরিবের বস্তি ভাড়া এখন দুই থেকে চার হাজার টাকা। বস্তির জায়গাগুলো বেশির ভাগই সরকারের। রাজনৈতিক মাস্তানরাই সব জায়গা ভাড়া দিয়ে খায়। দলগুলো মিছিলের জন্য এখান থেকেই লোক সংগ্রহ করে। ফুটপাথ, রেলস্টেশন, বাসস্ট্যান্ড, লঞ্চঘাটসহ বহু খালি জায়গায় মানুষ থাকে। রাজধানীতে নাকি এখন ৫০ লাখ মানুষ এসব এলাকায় থাকে। প্রতি বছর চার থেকে পাঁচ লাখ লোক রাজধানীতে আসে। গ্রামেও একই অবস্থা। দশ থেকে বারো কোটি লোক গ্রামে থাকে। এর ভেতর রয়েছে কৃষিশ্রমিক, হাটবাজারের দিনমজুর, ভিুক, ুদ্র ব্যবসায়ী। এদের সবারই নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। এরা ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাতে পারে না। ফলে তাদের জীবন থেকে অশিা দারিদ্র্য আর কখনোই যায় না। একটা জাতির সব মানুষকে নিররতা ও দারিদ্র্যমুক্ত করতে ৬৪ বছর লাগার কথা নয়। দেশের জনসাধারণ বিশেষ করে গরিব দিনমজুর ও নিম্নমধ্যবিত্তদের অবশ্যই বুঝতে হবে রাজনীতি, সরকারব্যবস্থা ও রাষ্ট্রীয় দর্শনে কোথাও বিরাট গলদ রয়ে গেছে। রাজনীতিবিদ, সংসদ সদস্য, আমলা, সরকার ও রাষ্ট্রের বন্ধুদের সবার বাড়ি-গাড়ি, ধনসম্পদ আছে এবং তা দিন দিন বেড়েই চলেছে। ধনীরা সচিব, জেনারেল, মন্ত্রী, সংসদ সদস্যদের সাথে আত্মীয়তা করেন। এমনকি আওয়ামী নেতাদের সাথে জামায়াত, মুসলিম লীগ ও বিএনপি নেতাদের আত্মীয়তা আছে এবং নতুন করেও হচ্ছে।
শুরুতেই বলেছি, বাজেটের বর্তমান দর্শন ও ব্যবস্থাপনায় এ দেশের গরিবের ভাগ্য পরিবর্তন হবে না। কারণ এ বাজেট সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য তৈরি করা হয় না। সোজা কথায় বলা যেতে পারে, এ বাজেট সাধারণ মানুষের জন্য নয়। এই তো ক’দিন আগেই আমরা সবাই দেখলাম, প্রাইমারি স্কুলের শিকেরা পুলিশের হাতে কিভাবে লাঞ্ছিত হয়েছেন। জলকামান দিয়ে তাদের শায়েস্তা করা হয়েছে। প্রাইমারি স্কুলের শিকেরা আর ক’ টাকাই বা বেতন পান। তাদের কাছে লেখাপড়া করেই তো সবাই প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, সচিব, বিচারপতি, জেনারেল হন। সবার জন্য বাজেটে বিরাট বিরাট বরাদ্দ। শুধু প্রয়োজনীয় বরাদ্দ নেই শিকদের জন্য। জনপ্রতিনিধির নামে মন্ত্রী-এমপিরা শুল্কমুক্ত দামি গাড়ি পান, সরকারি দামে দামি জমি পান। হয়তো তাদের অনেকেরই শিকদের মতো লেখাপড়াই নেই। বাজেটে কৃষি, বাসস্থান ও চিকিৎসার জন্য তেমন বরাদ্দ নেই। সরকার ও রাষ্ট্রের সাথে যাদের সম্পর্ক আছে তাদের সবার জন্যই বরাদ্দ আছে। আমার প্রশ্ন হলো, এ অঞ্চলের বাঙালি বা মুসলমান বাঙালিরা কেন স্বাধীন হয়েছে ৪০ বছর আগে। ৪০ বছর ধরেই সর্বহারা থাকার জন্য? তাদের চিকিৎসা, বাসস্থান, খাদ্য, বস্ত্র কিছুই তো হয়নি ৪০ বছরে। তাদের ছেলেমেয়েরা অল্পস্বল্প লেখাপড়া করলেও চাকরি পায় না।
আরেকটি কথা আমি অবশ্যই বলব, ভাগ্যের দোহাই দিয়ে গরিব মানুষদের আর ধোঁকা দেবেন না। চোর ডাকাত আর বদমায়েশদের ভ্যগ্যের পরিবর্তন হবে সাধারণ মানুষের হবে না এমন সমাজ নিশ্চয়ই আমরা প্রত্যাখ্যান করি। এমন সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা শত বছরেও গরিবদের ভাগ্যের পরিবর্তন করতে পারবে না। বর্তমান শোষণমুখী রাষ্ট্রব্যবস্থায় সাধারণ মানুষের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হবে না। সত্যি কথা বলতে কী, বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থা অকল্যাণকর এক ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। 
লেখক : কবি ও সাংবাদিক
ershadmz40@yahoo.com

বৃহস্পতিবার, ১৪ জুন, ২০১২

আবাসন খাতে ভারতীয় বিনিয়োগ


॥ এরশাদ মজুমদার ॥


জেনারেল মইন ও সাবেক আমলা ফখরুদ্দীনের তথাকথিত কেয়ারটেকার সরকারের আমল থেকে বিগত ছয় বছর ধরে আবাসন শিল্পে মন্দা বিরাজ করছে। এই শিল্পের উদ্যোক্তাদের বড় আশা ছিল রাজনৈতিক সরকার এলে মন্দা ভাব কিছুটা হলেও কেটে যাবে। বড়ই দুঃখের বিষয়, সেই মন্দা এখনো জারি রয়েছে। অপর দিকে রাজনৈতিক কারণে আবাসন শিল্পের সংগঠন রিহ্যাবেরও এখন খুবই দুরবস্থা যাচ্ছে। সেখানে নির্বাচন হচ্ছে না কয়েক বছর ধরে। এক সরকারি এমপি সভাপতি হয়ে বসে আছেন। ফলে রিহ্যাবের কার্যক্রম এক ধরনের স্থবির হয়ে আছে। রিহ্যাবের মর্যাদা এখন আর আগের মতো নেই। সদস্যদের ভেতর নানা গ্রুপ। ঠিক এমনি এক সময়ে ভারতের সাহারা গ্রুপ এসেছে বাংলাদেশে আবাসন খাতে বিনিয়োগ করতে। হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে, সাহারা বাংলাদেশে হঠাৎ করে আসেনি। পর্দার পেছনে সাহারার আগমনকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য প্রস্তুতি চলছিল। দিনণ এবং লেনদেন সব ঠিকঠাক করেই সাহারা বাংলাদেশে এসেছে। সাহারার আগমনকে হিন্দুস্তানি ভাষায় ধামাকা বলা হয়। এসেই মনে হলো ভিনি ভিসি ভিডি। মানেÑ আসলাম দেখলাম আর জয় করলাম। প্রতিমন্ত্রীর কোলাকুলির দৃশ্য আমরা টিভিতে দেখেছি। আহা সে কী আনন্দের দৃশ্য! না বলা কথা ছিল, ভাই, এত দিন পরে কেন এলে। আমরা তো বসেই আছি তোমাদের আগমনের জন্য। সেই যে পাকিস্তানি জেনারেলকে পরাজিত করে আমাদের রাজা বানালে, তারপর তো দেখতে এলে না। এত দিন তো অনেক কিছুই নিয়েছ, শুধু বাকি ছিল আমার দেশের মাটি। তুমি তো বলেছ ভাই, মায়ের কাছে এ দেশের অনেক গল্প শুনেছ বাল্যকালে। এখানে তোমার বাড়ি। তাহলে তো তোমার হক আছে আলবত। কোম্পানির নাম দিয়েছ মাতৃভূমি। আহা, কী আবেগি নাম! দেশপ্রেম না থাকলে অমন নাম কেউ রাখে কি? সবচেয়ে ভালো কাজ করেছ আমাদের প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয়স্বজনকে দিয়ে কাজটা করাচ্ছ। ব্যবসায়ীদের নাকি এ রকমই নিয়ম। যার কাছে মতা আছে তার সাথে হাত মেলাও। তাহলে ব্যবসায়ের কাজটা খুবই স্মুথ ও সোজা হয়ে যায়। সে দিক থেকে সাহারা ভাই তুমি সঠিক পথে আছো। আর একেবারেই সঠিক সময়ে এসে গেছ। তোমাদের পুরনো ভিটেমাটি ফেরত দেয়ার জন্য আমাদের প্রিয় প্রধানমন্ত্রী এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
ইতোমধ্যে খবরের কাগজে প্রকাশিত হয়েছে, শোভা বাজারের মহারাজার নাকি বিক্রমপুরে এক লাখ একর জমি পড়ে আছে। এটা জমিদারির জায়গা, না খাসজমি তা আমরা এখনো জানতে পারিনি। সাহারা ভাইয়েরও নাকি মাত্র এক লাখ একর জমির দরকার। ১৬০৮ বা ১০ সালে জব চার্নক গরিব চাষিদের কাছ থেকে কোলকাতা, গোবিন্দপুর ও সুতানুটি নামের তিনটি গ্রাম কিনে শহরের পত্তন করেছিলেন। সেই শহরই কোলকাতা শহর নামে পরিচিত হয়েছে। আমাদের কবিগুরুর বাপ-দাদারাও কোলকাতা শহরে গিয়ে জজমানি শুরু করেছিলেন। সেখান থেকেই তারা ঠাকুর বলে পরিচিতি পান। আসলে ছিলেন কুশারী। নয়া ঠাকুরদের কপাল ভালো, ১৭৫৭ সালে ইংরেজরা বাংলা দখল করে নিজেদের রাজত্ব শুরু করেছিলেন। আর যায় কোথায়? নয়া ঠাকুরদের কপাল খুলে গেল। কাশিমবাজার কুঠিতে ইংরেজরা যাদের সাথে রেখে ষড়যন্ত্র শুরু করেছিল, তাদের একজন ছিলেন শোভা বাজারের জমিদার। ১৯০ বছর শোষণের পরও ইংরেজরা আমাদের নমস্ব। তাহলে ইংরেজের খয়ের খাঁ শোভা বাজারের জমিদার বংশও নমস্ব হবেন না কেনো?
দেশের বড় বড় অর্থনীতিবিদ বলেছেন, সাহারা গ্রুপ আবাসন ছাড়া অন্য খাতে, যেমন বিদ্যুৎ, অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ করছে না কেন? আবাসন খাতে তো আমাদের বড় বড় ডেভেলপার আছেন। তারা তো সংবাদ সম্মেলন করেই বলেছেন, সুযোগ পেলে তারাও বড় বড় স্যাটেলাইট শহর বানাতে পারবেন। স্থানীয় ডেভেলপাররা হক-হালালি কথা বলেছেন। দৈনিক মানবজমিন ইতোমধ্যে সাহারা গ্রুপ সম্পর্কে বড় একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, ভারতে সাহারা গ্রুপের ইমেজ মোটেই ভালো নয়। যেখানে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে সরকার প্রায় বছরখানেক ধরে নানা অসুবিধায় আছে, সেখানে সাহারা গ্রুপকে ওই সেতুর জন্য বিনিয়োগ করতে আহ্বান না করে আবাসন খাতে বিনিয়োগের আহ্বান জানানোর ব্যাপারটা রহস্যজনক। তাও আবার প্রধানমন্ত্রীর অতি নিকটাত্মীয়কে সাহারার পার্টনার করে। এই তো ক’দিন আগে দেখলাম, সাহারা গ্রুপ আমাদের ক্রিকেট বোর্ডকেও শত শত কোটি টাকা দিয়ে সাহায্য করবে। আসতে না আসতেই নানা দিকে চোখ পড়েছে সাহারার। ক’দিন পরে শুনব সাহারা মিডিয়াতেও বিনিয়োগ করবে এবং সেখানে স্লিপিং পার্টনার হবেন প্রধানমন্ত্রীর চোখের মণি। হঠাৎ করে সাহারাকে নিয়ে এমন হইচই কেন শুরু হয়েছে বুঝতে পারি না।
বাংলাদেশের অনেক আবাসন ব্যবসায়ী মিডিয়ায় পুঁজি বিনিয়োগ করে নিজেরাই নিজেদের কামড়াচ্ছেন। নিজেদের মালিকানার মিডিয়াগুলোকে প্রতিপকে ঘায়েল করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন। আবাসন ব্যবসায়ীদের এসব কাগজ বা টিভি চ্যানেলে অনেক নামীদামি সাংবাদিক কাজ করছেন এবং বিভিন্ন ফোরামে ফোরামে মালিকের পে বেশরম ওকালতি করছেন। দ্বিতীয়টি হলো পোশাক রফতানিকারকেরা আর তৃতীয়টি আবাসন শিল্পের মালিকেরা। এ তিনটি সেক্টরে অনিয়ম আর দুর্নীতি হয়েছে সবচেয়ে বেশি। তাই জেনারেল মইনের সরকারের আমলে সবচেয়ে বেশি বিপদ নেমে এসেছিল এদের ওপর। যদিও আমরা তা সমর্থন করিনি। কারণ ওই সময়ের হামলার ফলে অর্থনীতিতে স্থবিরতা নেমে এসেছিল। দুর্নীতি দমনের কথা বলে সেই সরকারের কর্তারা ব্যাপক দুর্নীতি করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বহু ব্যবসায়ী কোটি কোটি টাকা দিয়ে অত্যাচার থেকে রা পেয়েছে। জেনারেল মইনের সরকারের ভয়ে যারা দেশত্যাগ করেছিলেন, তারাই পরে একই মঞ্চে বসে লেনদেনের কথা বলেছেন।
আমার ছেলে আমাকে প্রশ্ন করেছে, বাবা তুমি কি বর্তমান অসাম্যতার বেনিফিসিয়ারি? উত্তরে আমি হ্যাঁ-সূচক জবাব দিয়েছিলাম। আমিও তো এই সমাজের একজন সুবিধাভোগী। বিগত ৬৪ বছরে আমাদের এই দেশে, আমাদের সমাজে অশিা, নিররতা, দারিদ্র্য আর শোষণ অত্যন্ত লজ্জাজনকভাবে চালু রয়েছে। মুক্তির আশা করে ১৯৭১ সালে আমরা পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করে বাংলাদেশ বানিয়েছি। স্বাধীন বাংলাদেশেরও ৪০ বছর পার হয়ে গেছে। কিন্তু বেশির ভাগ মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। ১৯৭০ সালে যে লোকটি ২০০ টাকার কেরানি ছিলেন সেই লোকটি এখন হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক। যে লোকটি ১৯৭০ সালে দুই টাকা রোজ মজুরি পেতেন তিনি এখন হয়তো ৩০০ টাকা পান। ১৯৭০ সালে এক কেজি চালের দাম ছিল ৫০ থেকে ৬০ পয়সা। আর এখন এক কেজি চালের দাম ৩০ থেকে ৭০ টাকা। যিনি ২০০ টাকা বেতন থেকে দুই হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন, তিনি খান ৭০ টাকা দামের চাল। হয়তো তিনি জানেনও না চালের কেজি কত? কিন্তু ৩০০ টাকার দিনমজুরকে জানতে হয়। ক’দিন আগে সোনাগাজীর কাশেমের সাথে দেখা হয়েছিল। তারা কয়েক জেনারেশন ধরে এক নামকরা বাড়িতে কাজ করে। কিন্তু ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন করতে পারেনি। কারণ লেখাপড়া শেখেনি। সমাজ তাদের লেখাপড়া শিখতে দেয়নি। কাশেমের মেয়ে এসএসসি পাস করেছে কিন্তু টাকার অভাবে কলেজে ভর্তি হতে পারছে না। বাড়তি আয়ের জন্য কাশেমের একটি চাকরি দরকার। অপর দিকে মেয়ের বিয়ে দিতে গেলেও যৌতুকের জন্য কাশেমের লাখখানেক টাকা লাগবে। আপনাদের একজন কাশেমের খবর দিলাম। বাংলাদেশের আরেকজন স্বাধীন নাগরিকের কথা বলছি। ইনি একজন মহাগরিব নিরর মহিলা। স্বামী তালাক দিয়ে চলে গেছেন। মহিলার দুই মেয়ে অন্যের বাড়িতে কাজ করে। আর মহিলা ভিা করেন। এই সমাজই ওই পরিবারটিকে শোষণ করছে। এটি চলছে বলেই আমি বাসার জন্য কাজের মেয়ে পাই অতি সস্তায়। রাস্তায় রিকশা, মুটে, শিশুশ্রমিক পাওয়া যায়। ওরা গরিব ও শক্তিহীন হওয়ার কারণেই বাংলাদেশে পোশাক শিল্প গড়ে উঠেছে। ওরা গরিব বলেই জনশক্তি ব্যবসায় রমরমা হয়ে উঠেছে।
শত চেষ্টা করেও আবাসন ব্যবসায় নিয়মনীতি প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। এ ব্যাপারে সরকারও উদাসীন। সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলগুলোও উদাসীন। রিহ্যাব ছাড়াও কয়েক হাজার কোম্পানি ফ্যাটের ব্যবসায় করছে। যেকোনো লোক যেকোনো সময় এ ব্যবসায় শুরু করতে পারে। এখন এ ব্যবসায় জেলা ও উপজেলা শহরে চলে গেছে। রাজধানীতে অভিজাত এলাকার জমির মালিকেরা কিছুটা বেনিফিট পাচ্ছেন। এসব এলাকায় জমির দামের কোনো ঠিকঠিকানা নেই। ক্রেতারা নাকি বলেন, জমি আছে কি না বলুন। দাম যা চাইবেন তাই পাবেন। তবে বিষয়টা গোপন রাখতে হবে। এসব এলাকার জমি আবার বিতরণ করে সরকার। কাঠা ১৫-২০ লাখ টাকা। কিন্তু বাজারদাম কাঠাপ্রতি কয়েক কোটি টাকা। এর মানে হচ্ছে, চেনাজানা মানুষকে রাতারাতি ধনবান করে দেয়া। আবাসন ব্যবসায়ীরাও ৫০ কোটি টাকার জমি পাঁচ কোটি টাকা নগদ দিয়ে পজেশন নিয়ে নেন আর বিজ্ঞাপন দিতে থাকেন। আর টাকা আসতে থাকে। দু-তিন বছর পরে ফ্যাটের ডেলিভারি পাবেন, এখন থেকেই মাসে লাখ লাখ টাকা কিস্তি দিতে থাকেন। একটি ফ্যাটের দাম দুই কোটি টাকা থেকে ১০ কোটি টাকা। এখানেই তো কালো টাকার বিষয়টি উঠে এসেছে। টাকার হিসাব চাইলে তো ফ্যাট ব্যবসায় হবে না, ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা যাবে না, বিনিয়োগ বাড়ানো যাবে না। তাই কালো টাকাকে কালো জায়গা থেকে সাদা জায়গায় নিয়ে আসতে হবে। তাই তো সাদা মনের মানুষ খুঁজতে গিয়ে একজন ধনী মানুষকেও পাওয়া যায়নি। সব সাদা মনের মানুষ সাদামাটা সাদাসিধে জীবন যাপন করেন। ধন তাদের ধারেকাছেও আসতে চায় না। রাষ্ট্র নিজেই কালো টাকার জন্ম দেয়। রাষ্ট্রের প্রিয় মানুষেরাই কালো টাকার মালিক হন। রাষ্ট্র চাওয়া মাত্রই আপনাকে ধনী বানিয়ে দিতে পারে। এখন প্রশ্ন হলো, ওই ধন কালো না সাদা? ১৯৭২ সাল থেকেই আমি কালো টাকার বিষয়ে লিখে আসছি। সাদাকালো শিরোনামে একটি নিয়মিত কলাম লিখতাম দৈনিক জনপদ-এ। আমাদের যে রাষ্ট্রব্যবস্থা, তাতে কালো টাকার জন্ম একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। যেমন বিয়ে না করে সন্তান জন্ম দেয়া একটি অবৈধ কাজ। ধর্ম ও আইনের চোখে একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। নারী-পুরুষের অবৈধ মিলন এ জগতের কোথাও থেমে নেই। কোন সমাজ এই অবৈধ কাজকে স্বীকৃতি দিয়ে বৈধতা দিয়েছে। তেমনি কালো টাকারও আইনি চোখে স্বীকৃতি নেই। কিন্তু রাষ্ট্র ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কারণে প্রতিনিয়তই কালো টাকার জন্ম হচ্ছে। যারা কালো টাকার মালিক হন তারা রাষ্ট্রের বন্ধু বা বন্ধুদের বন্ধু। যেমনÑ পুঁজি বিকাশের জন্য উদ্যোক্তাদের রাষ্ট্র নানা রকম সুযোগ দিয়ে থাকে। পূর্ব পাকিস্তানে পুঁজি বিকাশের কথা বলে ১৯৬০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা নানা ধরনের সুযোগ সুবিধা দাবি করে দেনদরবার করেছিলেন। সে সময় বেশ কিছু ২৫০ লুমের পাটকল স্থাপিত হয়েছিল। একই সময়ে ওজিএল বা ওপেন জেনারেল লাইসেন্সের কথা বলে বাঙালিদের পুঁজি গঠনের সুযোগ দেয়া হয়েছিল। বর্তমানে যে কালো টাকা লুকিয়ে আছে তা বিনা কর বা জরিমানায় সাদা করলে কয়েকটি পদ্মা সেতু হতে পারে। কালো টাকার জন্ম হয় চলমান রাজস্বব্যবস্থার কারণে। একটু আগেই বলেছি, রাজউকের প্লট ২০ লাখ টাকায় যখন কাঠা বিক্রি হয় তখন এর বাজারদর তিন কোটি টাকা। এই প্লটগুলো পান রাষ্ট্রের বন্ধুরা। এই প্লট যখন কেউ বিক্রি করেন তখন কি দলিলে তিন কোটি টাকা দেখান? না, দেখান না। এভাবে জমি বেচাকেনার সময়ও দলিলে আসল দাম উল্লেখ করা হয় না। প্রতিদিনই কালো টাকার জন্ম হচ্ছে, আর একে সাদা করার জন্য সরকারের ওপর চাপ থাকবে। কালো টাকা সবচেয়ে বেশি থাকে ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, রাজনীতিক, আমলা ও সরকারি কর্মচারীদের কাছে। এবার রাজনৈতিক কারণে যে ব্যাংকের অনুমতি দেয়া হয়েছে, তাতে লোকজন পরিচালক হচ্ছে ১০০ কোটি টাকা দিয়ে। কিন্তু কাগজ-কলমে দেখাচ্ছে ১০ কোটি টাকা। যিনি রাজনৈতিক কারণে অনুমতি পেয়েছেন তার কোনো পুঁজি লাগবে না। তিনি হবেন ব্যাংকের চেয়ারম্যান। শুধু অনুমতির তদবির করার জন্যই তিনি পাবেন হয়তো চার-পাঁচ শ’ কোটি টাকা। অথচ এই টাকা তিনি জীবনেও দেখেননি।
আবাসন ও চিকিৎসা খাতেও কালো টাকার ছড়াছড়ি। রাতারাতি ধনী হওয়ার জন্য সবচেয়ে বড় খাত। ২০ বছর আগে অজানা অচেনা এক ডায়াগনস্টিক সেন্টার খুলে এখন হাসপাতাল, মেডিক্যাল কলেজ, ওষুধ কোম্পানি, রিয়েল এস্টেটের মালিক। যেখানেই ব্যবসায়ের দ্রুত বিকাশ হয়েছে সেখানেই কালো জন্ম হয়েছে। অনেকে বলেন, আমরা তো টাকা বিদেশে নিয়ে যাইনি; দেশেই বিনিয়োগ করেছি। হাজার হাজার লোক কাজ করে। আমাদের ধনীদের ৮০ ভাগই বিদেশে বাড়ি কিনেছেন। কিন্তু দেশ থেকে কোনো টাকা বিদেশে নিয়ে যাননি। অনেক রাজনীতিকও বিদেশে বাড়ি কিনেছেন। এসব তো কালো টাকারই অবদান। ধনীদের আরেকটি বড় কাজ হচ্ছে, ছেলেমেয়েদের বিয়েতে দরাজদিলে কালো টাকার ব্যবহার করা। মুম্বাই সিনেমা দেখে দেখে বিয়ের অনুষ্ঠান তৈরি করা হয়। দাওয়াতের কার্ড থাকে ১৬-১৭টি। এসব বিয়েতে সমাজ ও রাষ্ট্রের নামীদামি তারকারা উপস্থিত থাকেন। এমনকি কোনো কোনো অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীরাও থাকেন।
ভারতের সাহারা গ্রুপ তেমনি একটি নামজাদা কালো টাকার মালিক। সেই টাকা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করার জন্যই সাহারা বাংলাদেশে আসছে। হয়তো তাকে টাকাও আনতে হবে না। স্থানীয় সহযোগীরাই হয়তো কালো টাকার জোগান দেবে। যেমন করে জগৎশেঠ কাইভকে টাকার জোগান দিয়েছিল। এমনও হতে পারে সরকার বলবে যত টাকা আনো কোনো কর বা শুল্ক দিতে হবে না। আবাসন খাতে বিদেশী বিনিয়োগ অল্পস্বল্প এখনো আসছে। কিন্তু তারা সরকারের আনুকূল্য পাচ্ছে না। হয়তো রাজউক বা সরকার এ ব্যাপারে কিছুই জানে না। বাংলাদেশে সাহারা আসার ব্যাপারে হয়তো কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে। এটা আবাসন খাতে বিনিয়োগ, না রাজনীতি তা এখনো স্পষ্ট নয়। অনেকেই বলছেন, সাহারার বিনিয়োগের বিষয়টি এখনো খোলাসা হয়নি। সাহারা কী বিনিয়োগ করবে? কত টাকা বিনিয়োগ করবে দেশবাসী তা জানে না। রাজউক কী চুক্তি করেছে তাও প্রকাশ করা হয়নি। রাজউক যদি সাহারাকে জমি দখল করে দেয় তাহলে দেশী বিনিয়োগকারীদের সেই সুযোগ দেবে না কেন? সরকারই বা এ ব্যাপারে এত রাখঢাক করছে কেন? 
লেখক : কবি ও সাংবাদিক
ershadmz40@yahoo.com

শুক্রবার, ৮ জুন, ২০১২

রাজনীতির মতা আর মতার রাজনীতি


॥ এরশাদ মজুমদার ॥


রাজা-বাদশাহদের যুগ পেরিয়ে আমরা আধুনিক যুগে এসেছি বলে ঢোল পিটিয়ে দেশে-বিদেশে সবাই বলছেন। একসময়ে রাজারা দিগ্বিজয়ে বের হতেন। জোর করে অন্যের দেশ দখল করতেন, আর বাহবা পেতেন। আমরা আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের নাম জানি। তিনি গ্রিসের মেসিডোনিয়া থেকে দেশ জয় করতে করতে ভারতবর্ষের উত্তরে এসেছিলেন। সে কথা আমরা জানি পুরুর সাথে তার যুদ্ধের গল্প থেকে। পরাজিত পুরুকে নাকি আলেকজান্ডার জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনি আমার কাছে কী ধরনের ব্যবহার আশা করেন। পুরু নাকি বলেছিলেন, রাজার কাছে রাজা যেমন ব্যবহার পেতে পারেন, সে রকম। পুরুর কথা শুনে আমরা খুব খুশি। হেরে গেলেও আমাদের রাজার সাহস আছে। সে সময়ে ভারতীয়রা এ ধরনের বহুবার বহু জায়গায় হেরেছে আর বিদেশীদের জয়গান গেয়েছে। এই তো দেখুন না, রাম বলে কেউ নেইÑ এ কথা বহুবার বলা হয়েছে। স্বয়ং কবিগুরু বলেছেন, রামের জন্ম কবির মনোভূমিতে। কিন্তু কে কার কথা শোনে। কবি কল্পনা করে রামায়ণ নামের মহাকাব্য লিখেছেন। সেই কাব্যই এখন প্রায় ধর্মগ্রন্থে পরিণত হয়েছে। বিদেশী রাজার এমন বিজয়গাথা জগতে কেউ কখনো দেখেছে কি না জানি না। শেষ পর্যন্ত বিদেশী বিজয়ী রাজাকে অবতার ও দেবতা বানানো হয়েছে। আর দেশী পরাজিত রাজা রাবণকে বানানো হয়েছে রাস। তেমনি বিদেশী দখলদার ইংরেজদের আমরা আজো স্মরণীয়-বরণীয় মনে করি। আজো আমরা কমনওয়েলথের সদস্য। এর অর্থ একদিন আমরা তাদের দখলে ছিলাম এবং তাদের প্রজা ছিলাম, সে কথা আমরা জোর গলায় জাহির করছি। এখনো আমাদের দেশের লোক স্যার টাইটেল পেলে খুশিতে আটখানা হয়ে যান। দেশী ভাইবেরাদরের সহযোগিতায় ইংরেজরা এই দেশটাকে ১৯০ বছর শাসন ও শোষণ করেছে। কী ধরনের শোষণ করেছে তা এখন আমাদের বন্ধুবান্ধব ও নতুন প্রজন্মের 
সন্তানেরা হয়তো ভুলে গেছে। আমাদের নতুন প্রজন্মের সন্তানেরা ইতিহাস নিয়ে তেমন মাথা ঘামায় না। তারা আজ নিয়ে ভাবে। গতকাল নিয়ে ভাবে না। হয়তো এমন অনেক তরুণ আছে, যারা ভালো করে দাদার নামও জানে না। হয়তো ওই নামটা তার কখনো প্রয়োজন হয়নি। হয়তো দাদা একেবারেই নগণ্য একজন মানুষ ছিলেন। তাই বাপ তার নিজের বাপের পরিচয় দিতে লজ্জা পেতেন। হয়তো বা ধনী হয়ে নিজের অতীতকে মুছে দিয়েছেন। এমন তরুণ বা তাদের বাবাদের ইতিহাস না জানলেও চলে। এ কারণেই আমাদের ইতিহাস নিয়ে এত কথা। প্রায় সবাই বলছেন, ইতিহাস বিকৃতি হচ্ছে। কোনটা সত্য ইতিহাস তা নিয়ে আমরা বিভ্রান্ত। যে দল যখন মতায় আসে, সে দল নিজের মতো করে ইতিহাস বলে। একদল বলে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। যদিও আমরা কেউ তার ঘোষণা শুনিনি। আদালত বলেছেন, বঙ্গবন্ধুই ঘোষণা দিয়েছেন। তাই এ নিয়ে আর কোনো কথা চলবে না। হাজার হলেও আদালতের ফরমান। ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধুর ইতিহাস নিয়ে প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদ বেকায়দায় পড়েছেন। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী হুমায়ূনকে লেখা বদলাতে হবে। এত দিন হুমায়ূন বানিয়ে বানিয়ে গল্প লিখতেন। কিন্তু ইতিহাস নিয়ে লিখতে গিয়েই ধরা পড়ে গেলেন।
জাতি হিসেবে আমাদের বায়া দলিল অর্থাৎ ইতিহাস আজো বিতর্কিত। কোনটা সঠিক, তা আজ আর বোঝা যায় না। আমি প্রায়ই বলি, জমির যদি বায়া দলিল থাকে, বংশের যদি বায়া দলিল থাকে, তাহলে দেশের বায়া দলিল থাকবে না কেন? আমরা তো আজো সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি, আমরা কি শুধুই বাঙালি, না বাঙালি মুসলমান। বিশ্ববাঙালি নামে এখন নতুন স্লোগান শুনতে পাচ্ছি। বিদেশের মাটিতে বিশ্ববাঙালি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সারা বিশ্বের বাঙালিরা উপস্থিত হন। এই সম্মেলনে যারা উপস্থিত হন, তাদের মধ্যে শুধু বাংলাদেশীদেরই একটি স্বাধীন রাষ্ট্র আছে, বাকি বাঙালিদের কোনো রাষ্ট্র নেই। পৃথিবীর ৩০ কোটি বাঙালির মধ্যে ১৫ কোটি বাঙালির কোনো স্বাধীন রাষ্ট্র বা দেশ নেই। পরাধীন বাঙালিরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাস করেন ও কাজ করেন। বিদেশি যারা বাস করেন তারা কেউ ভারতীয়, কেউ ব্রিটিশ বা কেউ অন্য কোনো দেশের। বাঙালি হলেও সবাই বাংলাদেশী নন। এমনকি আমাদের উপজাতিরাও নিজেদের বাঙালি মনে করেন না। জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধু যখন আহ্বান জানালেন, তোরা পাহাড়িরা সবাই বাঙালি হয়ে যা। তখন মানবেন্দ্র লারমা প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিলেন, আমরা বাঙালি নই। আমরা বাংলাদেশী।
রাজনীতির প্রধানতম উদ্দেশ্যই নাকি মতায় যাওয়া। কারণ, মতায় না গেলে আদর্শ বা উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করা যায় না। তাই মতায় যাওয়ার জন্য রাজনীতির প্রয়োজন। দল ছোট হোক বা বড় হোক, রাজনীতি করলে একদিন মতায় যাওয়া যাবেই। তার প্রমাণ মতাসীন মহাজোট। শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া মন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন কোনো দিনও দেখেননি। ভোট করে তিন-চার শ’র বেশি ভোট পান না। ভগবান বুদ্ধ বড়ুয়ার দিকে মুখ তুলে চেয়েছেন। তাই দিলীপ বড়ুয়া আজ মন্ত্রী। মেনন ও ইনুরও একই অবস্থা। মতায় যাওয়ার জন্য কৌশলগত কারণে নিজের মার্কা ত্যাগ করে নৌকা মার্কায় নির্বাচন করেছেন। ২০০৮ সালের ওই নির্বাচনে জয়লাভ ছিল ১০০ ভাগ গ্যারান্টেড। মেনন একবার জিয়ার আমলে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। ইনুর সে সুযোগও হয়নি। জীবনে একবারো এমপি বা সংসদ সদস্য হননি এমন অজানা-অচেনা লোকেরাও মন্ত্রী হয়েছেন। উর্দুতে একটা কথা আছেÑ ‘খোদা মেহেরবান তো, গাধা ভি পাহলোয়ান।’ শেখ হাসিনা যার ওপর খুশি হয়েছেন তিনিই মন্ত্রী হয়ে গেছেন। নির্বাচন না করেও মন্ত্রী হয়েছেন। নির্বাচনে যারা শলা দিয়েছিলেন জেতার জন্য তারাও আজ মন্ত্রীর পদমর্যাদায় উপদেষ্টা। লোকে বলে উপদেষ্টাদের মতা নাকি মন্ত্রীদের চেয়ে হাজার গুণ বেশি। শেখ হাসিনার মতা আছে তাই তিনি নিকট-দূর বহু আত্মীয়স্বজনকে পাহলোয়ান বানিয়ে দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর আমলেও তার আত্মীয়স্বজনেরা মতার স্বাদ পেয়েছিলেন। শুনেছি, গণচীনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইকে বিদেশী সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করেছিলেন, আপনার জীবনে সাফল্যের প্রধান কারণ কী? চৌ উত্তরে বলেছিলেন, আমি আত্মীয়দের সব সময় দূরে রেখেছি। শহীদ জিয়ার েেত্রও তাই শুনেছি। জিয়া নাকি আত্মীয়স্বজনদের কখনোই কাছে ঘেঁষতে দেননি। শেরে বাংলা অখণ্ড বঙ্গদেশের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে নিজের এক অযোগ্য ভাগিনাকে চাকরি দিয়েছিলেন। সংসদে এ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, প্রার্থীর যোগ্যতা সে প্রধানমন্ত্রীর ভাগিনা। বঙ্গবন্ধুর ভাগিনারাও তার মতায় থাকাকালে নানা ধরনের সুযোগ পেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতিকেও নাকি তিনি রাতারাতি সচিব বানিয়ে দিয়েছিলেন। নাম নাজানা বেয়াই সাহেবও মন্ত্রী হয়েছেন। মতা থাকলে বা মতায় থাকলে মতাবানেরা নিজের নামে এবং আত্মীয়স্বজনের নামে অনেক কিছু করেন। টাকা কিন্তু জনগণের, জনগণের নামে বিদেশ থেকে ধার করে আনা অথবা জনগণের কাছে আদায় করা টাকা। পাকিস্তান আমলে অনেক নাম বদলে গেছে। বাংলাদেশ আমলে সেসব আবার বদলেছে। যেমন ধরুন, ইংরেজ আমলে ব্যবসায় ছিল হিন্দুর, পাকিস্তান আমলে সেটা হয়েছে অবাঙালি মুসলমানের। বাংলাদেশ হওয়ার পর সেই ব্যবসায় হয়ে গেল বাঙালি আওয়ামী মুসলমানদের। মতার ধারা এমনিই চলে। আপনার মতা থাকলেই হলো। আইনের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত মতা, না হয় দলের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত মতা। রাজনীতি করলেও আপনার এই মতা থাকতে পারে, আবার রাষ্ট্র আপনার হাতে বা পাশে থাকলেও হতে পারে।
রাজনীতি না করেও মতায় আসা যায়। যেমন সামরিক আইন জারি করে, দেশের সংবিধান বাতিল করে সেনাপ্রধান মতায় আসতে পারেন। সেখানে তার সমর্থক থাকবেন সৈনিকেরা, আর সেনা অফিসারেরা। পাকিস্তান আমল থেকে আমাদের দেশে বহুবার সামরিক শাসন জারি হয়েছে। সেনাপ্রধানেরা মতায় এসে রাষ্ট্রপ্রধান, প্রেসিডেন্ট বা রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর ইন্তেকালের (স্থান পরিবর্তন) পর সামরিক শাসন জারি করে তারই বন্ধু খোন্দকার মোশতাক মতায় আসেন। তাকে সমর্থন দিয়েছে সেনাবাহিনী ও আওয়ামী লীগের একাংশ। পরে সেই মতা হাতবদল হয়ে চলে যায় সে সময়ের সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়ার কাছে। এর মধ্যে একমাত্র জেনারেল জিয়াই ছিলেন জনপ্রিয় শাসক। সেটা প্রমাণিত হয়েছে তার জানাজায় লাখো মানুষের অংশগ্রহণে। এ দেশে কারো জানাজায় এত মানুষের সমাগম হয়নি। জেনারেল জিয়াকে যারা দেখতে পারেন না, তাদের মত অবশ্য ভিন্ন। সামরিক আইন নিয়ে জাস্টিস মুনিমের একটি বই আছে। এটা ছিল তার পিএইচডি থিসিস। জেনারেল আইউবের সামরিক আইন জারি নিয়ে লিখতে গিয়ে তিনি সামরিক আইনের ইতিহাস বর্ণনা করেছেন। ইংল্যান্ডে প্রথম রাজারা এই আইন ব্যবহার করেন। তবে বলা হয়েছে, এটা কোনো আইন নয়। যুদ্ধের সময়েই শুধু এ আইন ব্যবহার করা যেতে পারে, 
শান্তির সময় নয়। জেনারেল আইউব যখন সামরিক আইন জারি করে মতা দখল করেছিলেন, তখন কোনো যুদ্ধাবস্থা ছিল না। এই তো কিছু দিন আগে জেনারেল মইন দেশে জরুরি অবস্থা জারি করতে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রফেসর ইয়াজউদ্দিনকে বাধ্য করেন। জেনারেল মইন একটা সিভিল সরকার নিয়োগ করে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সারা দেশে সেনা অফিসাররা প্রশাসন চালানোর দায়িত্ব নেন। দুর্নীতির মূলোচ্ছেদ করার নামে দেশের অর্থনীতিকে তছনছ করে ফেলেন। দেশের মানুষ মনে করে, জরুরি অবস্থা জারি করার প্রেতি তৈরি করেছে গোয়েন্দা বাহিনী। আর আওয়ামী লীগ বিশৃঙ্খল অবস্থা সৃষ্টির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। অথবা বলা যেতে পারে, জেনারেল মইনের মতা গ্রহণকে আওয়ামী লীগ সমর্থন করেছে। আর এ জন্য পুরস্কার হচ্ছে ২০০৮ সালের নির্বাচন। একসময় বলা হতো, ‘মাইট ইজ রাইট’। জোর যার মুল্লুক তার। মাঝখানে মনে হয়েছিল, সেসব দিন বাসি হয়ে গেছে। না, এখনো সেসব দিন বাসি হয়নি। এখনো শক্তি থাকলে উপায় হয়। রাষ্ট্রশক্তি থাকলে তো কথাই নেই। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো একটি রাষ্ট্র যদি কারো দখলে থাকে, তাহলে তো আর কথাই নেই। যিনি মতায় থাকবেন বা মতা দখল করবেন, রাষ্ট্র তার কথামতো চলবে। কিন্তু বলা হবে, আইনের শাসন চলছে। আগেই বলেছি, আইন তো তৈরি হয়েছে যারা রাষ্ট্র চালাবেন তাদের স্বার্থ রার জন্য। এমন দেশে জনগণের নামে সব কিছু হবে, কিন্তু জনগণ থাকবে না।
জেনারেল আইউব গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠিয়ে, রাজনীতিকদের হেনস্তা করে প্রায় দশ বছর মতায় ছিলেন। পরে আন্দোলনের মুখে জেনারেল ইয়াহিয়ার কাছে মতা দিয়ে বিদায় নিয়েছিলেন। আর জেনারেল ইয়াহিয়া সাধারণ নির্বাচন দিয়েও পাকিস্তানকে রা করতে পারেননি। বাংলাদেশের জেনারেল এরশাদও গণরোষের মুখে পদত্যাগ করে জেলে গিয়েছিলেন। এখনো তার বিরুদ্ধে বহু মামলা রয়েছে। এরশাদ মতা দখল করে বলেছিলেন, তিনি দিল্লির সাথে কথা বলেছেন। আওয়ামী লীগও এরশাদকে সমর্থন করেছিল। ’৮৬ সালের নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ এরশাদের সাথে হাত মিলিয়েছিল। এখনো এরশাদ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের সাথে রয়েছেন। মূলত এরশাদের মতার উৎসস্থল হচ্ছে দিল্লি। দিল্লি বাংলাদেশে ছোট-বড় তিন-চারটি পলিটিক্যাল টিম রেখে রাজনীতির মাঠে খেলাধুলা করে। জেনারেল আইউব মতা দখল করে বেসিক ডেমোক্রেসি চালু করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু একদলীয় শাসন চালু করেছিলেন নিজের মতাকে পোক্ত করার জন্য। এখন শেখ হাসিনা বলছেন, তিনি জানেন কিভাবে বিরোধী দলকে সোজা পথে আনতে হয়। কোথায় যেন এক টুকরো খবর দেখলাম, প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় বলেছেন, আগামী ২৫ বছরে বাংলাদেশে হিন্দু প্রধানমন্ত্রী হয়ে প্রমাণ করবেন, বাংলাদেশ একটি মহান সেকুলার দেশ। দিল্লির উসকানিতে বাংলাদেশকে সেকুলার ভূতে পেয়েছে। আওয়ামী লীগ এ বিষয়টা গভীরভাবে অনুধাবন করতে পারছে না, দিল্লিকে তুষ্ট করার জন্য আওয়ামী লীগ মতায় এসেই নানা ধরনের মামলায় জড়িয়ে পড়েছে। প্রায় চার বছর পার করতে চলেছে বর্তমান সরকার শুধু মামলা নিয়েই নিজেদের ব্যস্ত রেখেছে। দেশের উন্নয়ন নিয়ে সরকারের কোনো মাথাব্যথা নেই। সরকারের সামনে দেশের মানুষ নেই, বিরোধী দল নেই। অবিষয়কে বিষয় বানিয়ে সরকার নিজেকে ব্যস্ত রেখেছে। যেমন ধরুনÑ গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. ইউনূস সমস্যা । কেন যে হঠাৎ গ্রামীণ ব্যাংক সরকারের জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে তা দেশবাসী বুঝতে পারছে না। শেখ হাসিনার একটি সুবিধা আছে, তা হলোÑ তিনি যা বলেন, তার পারিষদ বলেন তার হাজার গুণ বেশি। লোককথা হচ্ছেÑ এক শিয়ালে ডাক দিলে শত শিয়াল হুক্কা হুয়া শুরু করে। কোনো শিয়ালই কারণ-অকারণ জানতে চায় না। এটা অবশ্য দলের জন্য খুব ভালো। আমরা যারা ৫০ বছর ধরে আওয়ামী সংস্কৃতি ও ঘরানার রাজনীতি দেখে আসছি, ল করেছি যে, এখানে শক্তিই প্রধান দর্শন, যুক্তি বা জ্ঞান কখনোই কাজ করেনি।
দল হিসেবে আওয়ামী লীগের চরিত্র আর দেশ হিসেবে আমেরিকার চরিত্র প্রায় একই রকম। জোর করে আদর্শ প্রচার করা উভয়েরই সংস্কৃতি। আমেরিকার ৮০ শতাংশ মানুষই অতি সাধারণ, দেশের রাজনীতি বা রাজনীতিবিদদের নিয়ে তারা কখনোই চিন্তা করে না। তারা নিয়মিত সপ্তাহের মজুরি পেলেই খুশি। দেশ কারা চালায়, কিভাবে চালায় তা নিয়ে আমেরিকার সাধারণ মানুষের কোনো মাথাব্যথা নেই। ফলে দু’টি রাজনৈতিক দলের কিছু নেতা আর ধনীরা দেশটা চালায়। ফলে আমেরিকা সারা পৃথিবীকে অশান্ত করে রেখেছে। প্রতিনিয়ত সারা পৃথিবীর মানুষকে ধমকের ওপর রেখেছে। কথা শুনতে বিভিন্ন দেশকে বাধ্য করছে। সেই আমেরিকাই আবার মানবতা, গণতন্ত্র, মানবাধিকার নিয়ে বিশ্ববাসীকে জ্ঞান দান করতে চায়। গণচীনের মতো দেশকেও আমেরিকা মানবতা ও গণতন্ত্র শিা দেয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে। নোবেল বিজয়ী বিশ্বখ্যাত জার্মান কবি গুন্টারগ্রাস বলেছেন, যে দেশের কাছে আণবিক বোমা নেই, সেই দেশকে শায়েস্তা করার জন্য আমেরিকা ও তার বন্ধুরা উঠেপড়ে লেগেছে। আর যার কাছে আণবিক বোমা আছে, তার ব্যাপারে কারো কোনো কথা নেই। মারণাস্ত্র আছে বলে ইরাকের সাদ্দামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে শান্ত দেশটাকে লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে। সেখানে এখন প্রতিনিয়ত মানুষ মারা যাচ্ছে। একই অবস্থা করেছে লিবিয়ার। এখন বলছে, ইরান আক্রমণের জন্য আমেরিকা প্রস্তুত। বিশ্বজনমত আমেরিকা ও তার বন্ধুদের বিরুদ্ধে, কিন্তু মতা জনমতের বিরুদ্ধে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মুসলিম লীগ করেছেন, পরে আওয়ামী মুসলিম লীগ করেছেন। মুসলিম শব্দ বাদ দিয়ে শুধু আওয়ামী লীগ করেছেন। কিন্তু কিছুতেই তিনি আরাম পাচ্ছিলেন না। শেষ পর্যন্ত একদলীয় শাসনব্যবস্থা চালু করার জন্য বাকশাল করে সব দল নিষিদ্ধ করেছিলেন। অথচ গণতন্ত্রের জন্য তিনি বছরের পর বছর জেল-জুলুম-নির্যাতন সহ্য করেছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার সময় তিনি পাকিস্তানের কারাগারে ছিলেন। সারা জীবন আমেরিকাকে সমর্থন করে বাংলাদেশে ফিরে এসে ভারতের অনুপ্রেরণায় একদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। মওলানা ভাসানী যখন পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের কথা বললেন, বঙ্গবন্ধুর নেতা সোহরাওয়ার্দী সাহেব বললেন, ৯৮ ভাগ স্বায়ত্তশাসন দেয়া হয়ে গেছে। আর যারা স্বায়ত্তশাসনের দাবিদার ছিলেন, তাদের লাঠিপেটা করার জন্য ধেয়ে গেছে বঙ্গবন্ধুর ভক্তরা। পরে দেখা গেল, বঙ্গবন্ধু নিজেই পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসনের দাবিদার হয়ে গেছেন। ’৭০-৭১ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু কখনোই সমাজতন্ত্রের সমর্থক ছিলেন না। কিন্তু বাংলাদেশ হওয়ার পর তিনি হয়ে গেলেন সবচেয়ে বড় সমাজতান্ত্রিক নেতা। রাশিয়া হয়ে গেল তার সবচেয়ে বড় বন্ধু দেশ।
কেউ কেউ বলেন, দণি এশিয়ায় আওয়ামী লীগ হলো সবচেয়ে শক্তিশালী বিরোধী দল। মতায় গেলেও আওয়ামী লীগ নিজেকে বিরোধী দলই মনে করে। আওয়ামী নেতারা নিজেরাই বলেন, ‘মতায় থাকলেও আমরা রাজপথ ছাড়ি নাই।’ ফলে, আওয়ামী লীগের দলীয় ভাষা মতায় এবং মতার বাইরে একই সমান। 
লেখক : কবি ও সাংবাদিক
ershadmz40@yahoo.com

বৃহস্পতিবার, ২৪ মে, ২০১২

আর কত দিন মানবিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অপোয়




॥ এরশাদ মজুমদার ॥


আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থায় মানবতা ও মানবাধিকার বিষয়টি তেমন গুরুত্ব পায় না। এর আগেও আমি এ বিষয়ে লিখেছি। আমাদের রাষ্ট্র্র মানুষের চেয়ে অনেক বড়। রাষ্ট্রকে আমাদের নেতারা অনেক বেশি মতা দিয়ে ফেলেছেন। মানুষের কল্যাণ ও মঙ্গলের ব্যাপারে আমাদের রাষ্ট্র্রের কোনো দর্শন নেই। রাষ্ট্র্র একটি আধুনিক ব্যবস্থা। জনগণের মতায়ন ও অধিকার প্রতিষ্ঠার চিন্তা থেকেই রাষ্ট্র্রব্যবস্থার জন্ম হয়েছে। বড় বড় দার্শনিক ও রাষ্ট্র্রবিজ্ঞানের পণ্ডিতেরা আধুনিক রাষ্ট্র্রব্যবস্থার প্রচারক ছিলেন। ইতোমধ্যেই এই ব্যবস্থা বেশ পুরনো হয়ে গেছে। কিছু লেখক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী ও চিন্তকজন এই ব্যবস্থা ঘুণেধরা বুর্জোয়া শোষণকামী ব্যবস্থা বলে গালাগাল দিচ্ছেন। কমিউনিস্ট রাষ্ট্র্রব্যবস্থা মানুষের চাহিদা পূরণ করতে পারেনি। প্রায় এক শ’ বছর ধরে এই ব্যবস্থা নিয়ে কমিউনিস্ট নেতারা পরীা-নিরীা চালিয়েছেন। সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের মাধ্যমে কমিউনিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার ব্যবহারিক দিকের পতন হয়েছে; কিন্তু দর্শন হিসেবে এটা এখনো জীবিত। আমি মনে করি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র্রব্যবস্থার চিন্তকেরা ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন। এই তো ক’দিন আগেই কার্ল মার্কসের দেড় শ’ বছর পালিত হয়েছে। জগদ্বিখ্যাত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী হিসেবে চে’কে তরুণেরা ভুলতে পারে না। চে’র ছবিওয়ালা টি-শার্ট এখনো তরুণদের খুবই প্রিয়। ইয়েমেনের তরুণেরাও চে’র ছবি নিয়ে মিছিল করছে। 
কার্ল মার্কস নিজেই ইসলামকে রেডিক্যাল ধর্ম হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এর আগেও আমি বলেছি, মার্কস যদি পুরো কুরআন শরীফ পড়তেন, তাহলে হয়তো তিনি ডাস ক্যাপিটাল এভাবে রচনা না করে কিছুটা আরো মানবিক করে তুলতে পারতেন। পবিত্র কুরআন শরীফে আল্লাহ ও বান্দাহ সম্পর্কিত আয়াত বা বাণী অতি অল্প। জগতের সব ধর্মীয় কিতাবই দাবি করেছে মানুষকে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। সব ধর্মের মানুষই বিশ্বাস করে মানুষ আল্লাহ, ভগবান, ঈশ্বর, গড, ইলোহা, ইলাহা কর্তৃক সৃষ্ট। কিতাবও এসেছে যুগে যুগে। শেষ কিতাব হচ্ছে আল কুরআন। কিছু মানুষ পুরনো কিতাব এবং এর ধ্যানধারণাকে আঁকড়ে ধরে আছে। নতুন কিতাব আল কুরআনের আবেদনকে মেনে নেয়নি। হয়তো এটাই মানুষের ভাগ্য। সেমিটিক ধর্মগুলো মূলত একই সূত্রে গ্রথিত। মূল সুর একই। হজরত ইবরাহিম সব জাতিরই পিতা। একই পিতার সন্তানেরা বিভিন্ন মতে বিভক্ত হয়ে গেছে। একে অন্যের সাথে মারামারি করছে। এমনকি আল কুরআন ও হজরত মুহাম্মদে যারা ঈমান এনেছেন তাদের ভেতরও অনেক বিভক্তি।
ইসলামকে ধর্ম মনে না করে একটা সামগ্রিক জীবনব্যবস্থা হিসেবে মনে করেও নতুন দুনিয়ার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। এর মধ্যে ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ইতোমধ্যেই বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। অন্য ধর্মাবলম্বীরাও ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে মেনে নিয়েছে। ইসলামে রাষ্ট্রব্যবস্থা, বিচার, চিকিৎসা, শিা, কৃষি, শিল্প, নির্বাচন, সরকার গঠন, প্রশাসন, সম্পদ বণ্টন, ওয়ারিশয়ানাসহ সব বিষয়ে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। এসব বিষয়ে গবেষণার দুয়ারও খোলা রাখা হয়েছে। দেড় হাজার বছর আগে ইসলামই প্রথম মানবতা ও মানবাধিকার নিয়ে কথা বলেছে। আল্লাহর রাসূল হজরত মুহাম্মদ সা: এ জগতে সর্বপ্রথম অধিকারহারা সাধারণ মানুষের রাষ্ট্র্র প্রতিষ্ঠা করেন। সেই রাষ্ট্র্র শুধু মুসলমানদের জন্য ছিল না। সেই রাষ্ট্রে সব ধর্মমতের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সে সময়ে সাধারণ মানুষের অধিকার বা রাষ্ট্রের কোনো ধারণাই ছিল না। মুসলমানেরা সে ধরনের কোনো রাষ্ট্র্র আজো প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। পূর্ণাঙ্গ ইসলামিক রাষ্ট্র্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। যেমন আমাদের রাষ্ট্র্র বাংলাদেশ। এ রাষ্ট্রের কোনো দর্শন বা আদর্শ আমি দেখতে পাই না। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের প্রধানতম সমস্যা হলো এ দেশের মানুষ মুসলমান। হাজার বছর ধরেই মুসলমান। সামাজিক মর্যাদা, সম-অধিকার পাওয়ার আশাতেই তখনকার মজলুম মানুষগুলো ইসলাম গ্রহণ করেছে। এর আগে ধর্মীয় বর্ণবাদ তাদের শোষণ করত। তখন ইসলামের মতো প্রগতিশীল আর কোনো ধর্ম, মতবাদ বা দর্শন ছিল না। তখন সমাজে সাধারণ মানুষ মুক্ত ছিল না। রাষ্ট্রও ছিল না, গণতন্ত্রও ছিল না। মতাবানেরাই দেশ ও সমাজ চালাত। যার শক্তি ছিল সেই ছিল শাসক বা রাজা-বাদশাহ। আধুনিক রাষ্ট্র্রব্যবস্থার ধারণা নিয়ে এসেছে ইংরেজেরা এ দেশে, যা অচল হতে চলেছে। নতুন কোনো ব্যবস্থা দৃশ্যমান নয় বলেই পুরনো অচল ব্যবস্থাটাই চলছে। আমাদের বাংলাদেশ ওই পুরনো ব্যবস্থাতেই চলছে। যে ব্যবস্থায় এক ভোট বেশি পেয়েই একজন নির্বাচিত হন। সংসদের এক সিট বেশি থাকলেই একটি দল বা গ্রুপ মতা দখল করে। ভোট পাওয়ার প্রশ্নে কোনো নিয়মনীতি বা নৈতিকতার ব্যাপার নেই। সোজা কথায় ভোট পেলেই হলো। কিভাবে পেয়েছে তা বিবেচ্য বা বিচার্য বিষয় নয়। নেতা নির্বাচনে নৈতিকতার বিষয়টা এখন আর কোনো গুরুত্ব্পূর্ণ বিষয় নয়। নেতার গুণের বিষয়টাও গুরুত্বপূর্ণ নয়। ভোট পেলেই হলো। ফলে আমাদের জাতীয় সংসদে এখন আর তেমন ভালো মানুষ নেই। ’৪৬ বা ’৫৪-তে যারা নির্বাচিত হয়েছিলেন এখন সে ধরনের মানুষের কোনো প্রয়োজন নেই। নমিনেশনের সময়ই বলা হয় টাকা না থাকলে নমিনেশন পাওয়া যাবে না। তাহলে আমরা জানতে পারলাম এক নম্বর যোগ্যতা টাকা। তারপরের যোগ্যতা কত মোটরসাইকেল, জিপ আর অস্ত্র আছে। সর্বশেষ যোগ্যতা হলো প্রার্থীর নিয়ন্ত্রণে কত মাস্তান আছে। একসময় নির্বাচনে প্রার্থীরা ছিলেন উকিল ও সমাজসেবী। এখন যেকোনো লোকই হতে পারেন। একবার নির্বাচিত হলেই তিনি বা তারা সমাজের এলিটে পরিণত হন। আর নির্বাচিত না হলেও তারা সাবেক এমপি, মন্ত্রী ও উপদেষ্টা। সবার বাড়ির সামনে নেমপ্লেট থাকে সাবেক অমুক। তাদের ছেলেমেয়দেরও সমাজে দাম বাড়ে। আমাদের মতো দেশে যারা মতায় থাকবেন তাদের মানবাধিকার থাকবে। আর থাকবে রাষ্ট্রের ও রাষ্ট্রের কর্মচারীদের। আপনি যদি ক্ষমতার বাইরে থাকেন তাহলে পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাবসহ আরো যারা আছে সবাই গায়ে হাত তুলতে পারবে। আপনার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা দিতে পারবে। আপনি সাবেক মন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রী হলেও কিছু আসে যায় না। আপনারা নিয়মিত টিভিতে দেখেন পুলিশের কী মতা আছে! পুলিশ সরকার, সরকারের আমলা, সরকারের সব রকমের শালা ছাড়া সবার গায়ে হাত তোলার অধিকার রাখে। পুলিশ খুব বিনয়ের সাথে বলবে, স্যার, আমরা রাষ্ট্রের গোলাম, আর রাষ্ট্র্র চালায় সরকার। রাষ্ট্রের আইন আর সরকারের নির্দেশেই আমরা আপনাদের গায়ে হাত তুলি। বলতে পারেন আমরা জনগণের খাদেম। জনগণের প্রতিনিধি হলেন নির্বাচিত সরকার। আরো বলবে, স্যার, রাষ্ট্র্র আর সরকারের খেদমত করা মানেই মানবতার খেদমত করা আর মানবাধিকার রা করা। আপনি যদি বলেন সংবিধান আমার সব মৌলিক অধিকার রক্ষা করছে। তখন পুলিশ অফিসার বলবে, স্যার, ওসব কাগুজে কথা। কাগজে তো কত কথাই লেখা থাকে। শুধু কাগজে থাকলেই কি দখলি স্বত্ব থাকে? না, থাকে না। এই তো দেখুন না, বিরোধী দলের চিফ হুইফ জয়নুল আবদিনের কী হাল হয়েছিল? তাকে যে পুলিশ অফিসার কিলঘুষি মেরেছিলেন তিনি প্রমোশন পেয়ে গেছেন। রাজনীতিতেও তাই, যিনি যত বেশি পুলিশের কিলঘুষি খাবেন তিনি তত বেশি উন্নতি লাভ করবেন। এই তো দেখুন না, সরকারি দলের এক নেত্রী যখন বিরোধী দলে ছিলেন, তখন বিনা কারণেই রাস্তায় শুয়ে পড়তেন। তিনি তো এখন খুবই সম্মানিত একজন মন্ত্রী। আপনারা মার খেয়ে, জেলে গিয়ে মন্ত্রী হন, আর আমরা মার দিয়ে, জেলে পাঠিয়ে প্রমোশন পাই। একেই বলে রাষ্ট্র্রব্যবস্থা। রাষ্ট্র্র থাকলে তার কতগুলো পোশাক থাকতে হয়। তেমনি পোশাক হলো মানবতা, মানবাধিকার, আইন আদালত ও সংসদ। রাষ্ট্র্র থাকলে সভ্য বলে গণ্য হওয়ার জন্য এসব রাখতে হবে এবং পরতে হবে। এই তো দেখুন না নামজাদা ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমদ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে উপন্যাস লিখতে গিয়ে ফেঁসে গেছেন। আদালত উপন্যাসটি শুদ্ধ করে লেখার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। দেয়াল নামক ইতিহাসভিত্তিক উপন্যাসটি লেখার জন্য প্রকাশক হয়তো অগ্রিম দিয়ে বসে আছেন। এ ছাড়া হুমায়ূন ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য বিদেশে থাকার সময় প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের প্রচুর ভালোবাসা পেয়েছেন বলে আমরা মিডিয়ার মাধ্যমে জানতে পেরেছি। হয়তো ভালোবাসার প্রতিদান দিতে গিয়েই এখন আদালতের ভালোবাসা নিতে হচ্ছে।
এই তো দেখুন, ক’দিন আগে বিরোধী জোটের ৩০-৩৫ জন নেতাকে জেলে পাঠানো হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে গাড়ি পোড়ানো ও বোমা ফাটানোর অভিযোগ এনেছে পুলিশ। আগেই বলেছি পুলিশ যারা মতায় থাকেন তাদের জন্য কাজ করেন। যদিও মাঝে মাঝে সরকারি কর্মচারীরা বলেন, আমরা রাষ্ট্রের কর্মচারী, কারো ভৃত্য নই। রাষ্ট্র্র যেহেতু যে বেশি ভোট পায় সেই চালায় তাই পুলিশসহ সব বাহিনী তাদের কথা শোনে। এখানে মানবাধিকার বা মানবতার কথা আসবে কেন। সরকার তো মানবতা আর মানবাধিকারের জন্য কাজ করছে। তাহলে সরকার বা তার বেতনভুক কর্মচারীরা শব্দ দু’টি লঙ্ঘন করবেন কেমন করে। যিনি বা যারা রা করেন তিনি বা তারা কিভাবে লঙ্ঘন-ভঙ্গন করবেন। সোজা কথায় বলা যেতে পারে পুলিশ ও সরকারি বাহিনী মনে করে সরকারের সমালোচক বা বিরোধী দলকে পেটানো, তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া তাদের পবিত্র দায়িত্ব। তারা তো এ কাজটি ব্রিটিশ আমল থেকেই করে আসছেন। ’৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণ- অভ্যুত্থানের সময়ও পুলিশ বাহিনী এ কাজটি খুবই দতার সাথে করেছে। আইন-আদালত তো ব্রিটিশ আমলেরই রয়ে গেছে। তাই আইনের কাছে সবার হাত-পা বাঁধা। চলমান আওয়ামী লীগ সরকার তো মহান পবিত্র মুক্তিযুদ্ধের সরকার। এ সরকারের সাথে নানা ধরনের পবিত্রতার সম্পর্ক রয়েছে। এই পবিত্রতা নিয়ে কোনো কথা বলা যাবে না। আমাদের আদালতও এখন মুক্তিযুদ্ধের আদালত। তাই বলতে হবে মহান মুক্তিযুদ্ধ, মহান আদালত, মহান বিচারপতি। এত দিন আমরা শুধু বলতাম মহান সেনাবাহিনী, এখন সবার নামের আগে মহান বা পবিত্র লেখা ভালো হবে বা মানানসই হবে। ব্রিটিশ আমলে মহান বা মহামান্য সরকার বাহাদুর বলে অনেকেই দামি দামি খেতাব পেয়েছেন। এখনো মহান মহামান্য সরকার বাহাদুর বললে সরকার খুশি হয় এবং নানা রকম পদক ও সম্মানী দেয়। হাজার হাজার বছর আগেও এসব রেওয়াজ ছিল। তখন রাজা-বাদশাহ ও শাসকদের গুণগ্রাহী খুবই কম ছিলেন। কারণ বেশির ভাগ প্রজা বা মানুষ ছিলেন অবোধ-অচেতন এবং অধিকারহারা। তারা জানতেন না মানবতা বা মানবাধিকার কাকে বলে। তারা জানতেন না প্রজা হিসেবে তাদের কোনো মতা আছে কি না। সাধারণ মানুষের ধারণা ছিল রাজা আর পারিষদ দেশ চালাবেন। এতে প্রজার কী করার আছে। প্রজারা কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। গ্রামের একজন চৌকিদারই ছিলেন সরকার বা বাদশাহর প্রতিনিধি।
মানবজাতির জন্য নির্ধারিত ও নির্দেশিত কিতাব আল কুরআন দেড় হাজার বছর আগেই ঘোষণা করেছে জগতে মানুষের চেয়ে বড় কিছু নেই। মানুষই শ্রেষ্ঠ, তাহার উপরে নেই। মানুষ তার স্রষ্টা ছাড়া কারো কাছে মাথা নত করবে না। মানুষকে পদানত করার জন্য যুগে যুগে হাজার বছর ধরে শক্তিমানেরা চেষ্টা চালিয়ে গেছে। সবাই মানুষের ঐক্যবদ্ধ শক্তির কাছে পরাজিত হয়েছে। কিন্তু শক্তিমানেরা যত দিন শক্তি থাকে, তত দিন এই সত্যটি বুঝতে পারে না বা বোঝার চেষ্টা করে না। মানুষের সার্বভৌমত্ব স্বাধীনতার এই খবরটি সুস্পষ্টভাবে আজো মানুষের কাছে পৌঁছেনি। এর মানে আল কুরআনের এই মহান বাণী জগতের ঘরে ঘরে পৌঁছেনি। আল্লাহর রাসূল হজরত মুহাম্মদ সা:-এর বাণী আজো সব মানুষের কাছে পৌঁছেনি। তাই মানুষের অন্তরের সব অন্ধকার আজো দূরীভূত হয়নি। প্রকৃতিগতভাবেই মানুষ স্বাধীন। তার চিন্তার স্বাধীনতা আরশিল আজিম পর্যন্ত। সেই মানুষকে শক্তির জোরে, খোদা বিরোধী আইনের জোরে যারা পরাভূত করে রাখতে চায় তারা খোদাদ্রোহী। তারা ফেরাউন, নমরুদ আর সাজ্জাদের বংশধর। কুরআন জানলেই মানুষ স্বাধীন হয়ে যাবে। জগতের কোনো কিছুই মানুষকে আর শৃঙ্খলিত করতে পারবে না। কুরআনের কাজ শুধু ভালো মানুষকে বেহেশত দান করা নয়। কুরআনের কাজ হচ্ছে, জগতে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করা। শুধু অল্পসংখ্যক মানুষ কুরআনের মর্মবাণী বুঝতে পেরেছে। তাই বিশ্বের সব ফেরাউন আজ ঐক্যবদ্ধ হয়েছে কুরআনের বিরুদ্ধে, সত্যের বিরুদ্ধে ও মানুষের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে। ফেরাউনি শক্তির ছায়া ও বাতাস বাংলাদেশেও এসে পৌঁছেছে। বুশ বা ওবামা ‘জিহাদ’ শব্দটিকে ভয় পান। বাংলাদেশেও শয়তানি শক্তি এই শব্দটিকে ভয় পায়। আপনারা প্রায়ই শুনবেন পুলিশ জিহাদি বইসহ অমুক জায়গা থেকে অতজনকে আটক করেছে। সেই জায়গায় বহু জিহাদি বই পাওয়া গেছে। কিন্তু আমরা জানি না ওই জিহাদি বইগুলো কী? ৫০ থেকে ৬০ দশকের দিকে আমরা যখন স্কুলে-কলেজে পড়তাম তখন ‘সোভিয়েত দেশ’ বা ‘পিকিং রিভিউ’ হাতে দেখলেই পুলিশ তাড়া করত। তখন বিশ্বব্যাপী সরকারগুলো কমিউনিজমকে ভয় পেত। ভাবতো এসব বই পড়লেই পোলাপাইন নষ্ট হয়ে যাবে। বাবা-মায়েরাও তাই মনে করতেন। পত্রপত্রিকাগুলোও ‘লালমিয়া’ বলে গালাগাল দিত। বিশ্বের ফেরাউনি শক্তি এখন ইসলাম ও কুরআনের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে। আল কুরআন নাকি মানুষকে সন্ত্রাসী করে তোলে। বিদ্রোহ-বিপ্লবের কথা বাদ দিয়ে কুরআন তাফসির বা ব্যাখ্যা করতে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। মুসলমান ও অমুসলমান সব সরকারই মনে করে কুরআনের জিহাদি আয়াতগুলো বাদ রাখা দরকার। ‘জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের বিদ্রোহ ফরজ।’ এটাই হচ্ছে আল কুরআনের পবিত্র বাণী। আল কুরআন হচ্ছে গণমানুষের মুক্তির সনদ।
আমাদের দেশটি আল্লাহর আইনে চলে না। চলে ব্রিটিশ আইন মোতাবেক। এসব কথা এর আগেও আমি আমার কলামে বহুবার বলেছি। সোনার বাংলার আদালত, বিচারব্যবস্থা, সরকারব্যবস্থা, সংসদÑ সব কিছুই চলে ব্রিটিশ আইনে। এ দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ মুসলমান। বেশির ভাগ মানুষ নিরর ও দরিদ্র। নিজেদের অধিকার সম্পর্কে তারা অবহিত নন। তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যই একদিন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়নি। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ৪০ বছর পার হয়ে গেছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের মুক্তি আসেনি। এমন রাষ্ট্র্রব্যবস্থায় মজলুমের মুক্তি নেই এ কথা তারা জানেন না। যে আলেম-ওলামারা ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছিলেন তাদের উত্তরসূরিরা এখন কোথায়? রাষ্ট্র্র স্বাধীন হলেই মানুষ স্বাধীন হয় না। তার বড় প্রমাণ পাকিস্তান ও বাংলাদেশ। বিশ্বে আরো বহু দেশ আছে যেখানে ভূগোল আর কিছু নেতা স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু মানুষ স্বাধীন হয়নি। এ কথা এখন নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয়ে গেছে যে, রাষ্ট্র্র স্বাধীন হলেই মানুষ স্বাধীন হয় না। প্রচলিত ধ্যানধারণা দিয়ে মানুষের সামগ্রিক মুক্তি কখনোই আসবে না। সরকারগুলো রাজা-বাদশাহ আর ফেরাউনদের প্রতিনিধি। সেই প্রতিনিধিদের আড্ডাখানা হলো জাতিসঙ্ঘ, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ইত্যাদি।
চলমান সরকারের জুলুম-নির্যাতন নিয়ে আমি তেমন মাথা ঘামাই না। দেশের প্রচলিত আইনই সরকারকে জুলুমবাজ করে তুলেছে। মানুষের নামে মানুষের কল্যাণের জন্য যেসব আইন তৈরি হয়েছে তা কখনোই মানুষের পে ছিল না, এখনো নেই। বারবার করে বলছি, বলেছি চলমান আইন দিয়ে এ দেশে কখনোই মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। এ দেশে সংসদকে বলা হয় সার্বভৌম। যেখানে নিয়মিত মানুষের বিরুদ্ধে আইন পাস হয়। যেখানে দিন-রাত অসত্য বাক্য বিনিময় হয়। আদালতেও মিথ্যা স্যা সত্য হিসেবে গৃহীত হয়। এমন সব আদালত যেখানে কোনো গরিব কোনো দিনও পৌঁছতে পারে না। কোন দল ভালো আর কোন দল মন্দ একজন কলাম লেখক হিসেবে এটা বিবেচনার দায়িত্ব আমার নয়। এখন মনে হচ্ছে চলমান সরকারের মতো এত অত্যাচার এর আগে কোনো সরকারই করেনি। এ কথা আমরা সব সময়ই বলে থাকি। আমি মনে করি, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য কলম ধরাই আমার প্রথম ও প্রধান কাজ। বাংলাদেশকে গণমানুষের রাষ্ট্রে পরিণত করতে হবে। সাধারণ মানুষ যখন বুঝবে এ রাষ্ট্রটা তার তখন সব দিক থেকেই দেশ উন্নতির দিকে এগিয়ে যাবে। জানি না, বাংলাদেশ গণমানুষের রাষ্ট্রে পরিণত হতে আর কত দিন লাগবে? 
লেখক : কবি ও সাংবাদিক
ershadmz40@yahoo.com

বৃহস্পতিবার, ১০ মে, ২০১২

পৃথিবীর দরিদ্রতম মানুষটি কে?




॥ এরশাদ মজুমদার ॥

পৃথিবীর দারিদ্রতম মানুষটি কে এ বিষয়ে আমার কোনো চিন্তাভাবনা কখনোই ছিল না। আমার মুরব্বি বিশিষ্ট ব্যাংকার মুজিবুল হায়দার চৌধুরী চিন্তাটি আমার মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু এ ব্যাপারে কোথাও কোনো তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায়নি। দারিদ্র্য নিয়ে আমাদের রাজনীতিক, অর্থনীতিক, দার্শনিক আর চিন্তকদের চিন্তার আর গবেষণার শেষ নেই। দরিদ্র কাকে বলে, দারিদ্র্য কত প্রকার, কী হলে একজন মানুষকে দরিদ্র বলা যাবে এসব কথা বলা হয়ে গেছে। শত শত বই লেখা হয়ে গেছে। ধনী দেশগুলো নানাভাবে দরিদ্র দেশগুলোকে ঋণ দিচ্ছে, সাহায্য দিচ্ছে। কিন্তু পৃথিবীর দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কমছে না। ৭০০ কোটি মানুষের এ পৃথিবীতে ৫০০ কোটি মানুষ দরিদ্র বা হতদরিদ্র। বিশ্বব্যাংকের বদৌলতে আমরা ইতোমধ্যে বহু নতুন শব্দ জানতে ও শিখতে পেরেছি। লেখক, সাংবাদিক, গবেষক, বুদ্ধিজীবীরা নিয়মিত বা হরহামেশা এসব শব্দ ব্যবহার করছেন। গত ৬৩ বছর ধরে আমরা দারিদ্র্যের কথা শুনে আসছি। দারিদ্র্য কমানোর জন্য কোথাও কারো কোনো চেষ্টার ত্রুটি নেই। কিন্তু দারিদ্র্য কমে না। এর রহস্য কী, কে বলতে পারবে? আমাদের প্রিয় পৃথিবীটা কি তাহলে একদিন এমন বিশাল দারিদ্র্য নিয়েই বিলীন হয়ে যাবে? আমার তো মনে হয় না এ জীবনে দারিদ্র্যমুক্ত একটি পৃথিবী দেখে যেতে পারব।
পৃথিবীতে এখনো যে সম্পদ আছে তার পূর্ণাঙ্গ ব্যবহার হয়নি। যেটুকু সম্পদ ব্যবহার হচ্ছে তার ৯৯ শতাংশেই চলে যাচ্ছে ধনী ও মতাবানদের কাছে। মতাবান আর ধনী দেশগুলো এ জনসম্পদ দিয়ে কী করছে? বেশির ভাগ উদ্বৃত্ত সম্পদ ব্যবহার হচ্ছে যুদ্ধে, সাধারণ মানুষকে হত্যা করার জন্য। সম্প্রতি ইউরোপ ও আমেরিকায় অকুপাই আন্দোলন হয়েছে। এ আন্দোলনে বহু মানুষ আহত ও নিহত হয়েছে। অকুপাই আন্দোলনের নেতাদের দাবি ছিল পৃথিবীর ৯৯ শতাংশ সম্পদের মালিকানা চলে গেছে এক ভাগ মানুষের কাছে। সেই এক ভাগ মানুষই পৃথিবীটাকে চালাচ্ছে। জগৎব্যাপী অশান্তি সৃষ্টি করে রেখেছে। তারাই জাতিসঙ্ঘকে নিয়ন্ত্রণ করে। জাতিসঙ্ঘ তাদেরই কথামতো চলে। জাতিসঙ্ঘই যুদ্ধের অনুমতি দেয়। আফগানিস্তানে যুদ্ধ চলছে অনেক বছর ধরে। এ যুদ্ধের কারণ কী, কেন এ যুদ্ধ চলছে কেউ বলতে পারে না। যুদ্ধের ফলাফল কী হবে তা আমরা সবাই জানি। ওবামা প্রশাসন এখন তালেবানদের সাথে আলোচনা শুরু করেছে। এই তো ৩০-৪০ বছর আগেও পৃথিবীর অবস্থা এমন ছিল না। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আমেরিকা এবং তার দোসররা এমন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে, যখন খুশি যেখানে সেখানে যুদ্ধ বাধিয়ে দিচ্ছে। এক সময় আমেরিকা এবং তার মিত্ররা কমিউনিজমকে ধ্বংস বা প্রতিহত করার জন্য লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে। তখন ইসলাম বা বেকুব মুসলমানেরা ছিল তাদের বন্ধু। কমিউনিজম দমনের জন্য মুসলমানেরা অন্ধের মতো পশ্চিমাদের সমর্থন করেছে। আজ সেই পশ্চিমারাই সন্ত্রাস দমনের নামে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। তাদের এই যুদ্ধে বাংলাদেশের সরকারগুলোও সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের একশ্রেণীর বামপন্থী আর বুদ্ধিজীবীরা আমেরিকার এই ভাঁওতাবাজিকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। সন্ত্রাস দমনের নামে ইসলামকে ধ্বংস করার এ উদ্যোগকে সমর্থন করার জন্য বিভিন্ন দেশকে আমেরিকা অর্থসাহায্য দিচ্ছে।
ক’দিন আগে নোবেল বিজয়ী জার্মান কবি গুন্টার গ্রাস একটি কবিতা লিখে পৃথিবীকে কাঁপিয়ে দিয়েছেন। মনের যাতনায় জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তিনি এই কবিতা লিখেছেন। সারা বিশ্বের বিখ্যাত কাগজগুলো তার ওই কবিতার অনুবাদ প্রকাশ করে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। আমিও উদ্বুদ্ধ হয়ে তার সেই কবিতা অনুবাদ করেছি। এই মহান কবি বলেছেন, সত্য কথা না বলে এতদিন চুপ থাকার জন্য তিনি এখন অনুতপ্ত। তিনি নিজেকে অপরাধী সাব্যস্ত করে নিন্দা করেছেন। গ্রাস তার কবিতায় যে সত্য কথাটি তুলে ধরেছেন তা হলো, ইসরাইলের কাছে আণবিক বোমা আছে, কিন্তু তা নিয়ে শক্তিধরেরা কোনো উচ্চবাচ্য করছে না। ইরান আণবিক বোমা তৈরি করছে এই সন্দেহে ইরানের বিরুদ্ধে নানা রকম ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। গ্রাস এ ব্যাপারে নিজের দেশ জার্মানিরও সমালোচনা করেছেন। বিশ্বের চলমান অশান্তির জন্য গ্রাস শক্তিধর দেশগুলোকে দায়ী করেছেন। মতার লড়াই ও অন্যকে নিজের প্রভাবে রাখা হাজার বছর আগেও ছিল। বিশ্ব জয় করে সেকান্দর বাদশাহ বা আলেক্সান্ডার ‘গ্রেট’ টাইটেল পেয়েছিলেন। একসময় বলা হতো বীরভোগ্যা বসুন্ধরা। বা জোর যার মুল্লুক তার। সেসব যুগ বা শতাব্দী পেরিয়ে মানুষ নাকি সভ্য হয়েছে। বিশ্বসভ্য হয়েছে এ ধারণাটা একেবারেই মিথ্যা। পুরো বিশ্বটাকে নিজেদের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য আমেরিকা তার পদলেহী দোসরেরা ভয়ভীতি দেখিয়ে দমন করে রেখেছে। আপনারা নিজেরাই দেখছেন, বাংলাদেশ গরিব ও দুর্বল হওয়ার কারণে শক্তিশালী দেশগুলো কী ধরনে ব্যবহার করছে। সত্যি কথা বলতে কী চলমান বিশ্বের অবস্থা দেখে আমার হয় না আমরা সভ্যজগতে বাস করছে।
শত চেষ্টা করেও আমরা গত ৬৩ বছরে আমরা দেশের মানুষকে দারিদ্র্যের ভয়াল অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে পারেননি। কারণ আমাদের রাজনীতিক ও আমলারা সাধারণ মানুষের উন্নতির দর্শনে বিশ্বাস করেন না। কৃষক শ্রমিকদের নিয়ে রাজনীতি আমাদের দেশে খুবই জনপ্রিয়। এতে অতি অল্প সময়ে রাজনীতিকেরা জনপ্রিয় হতে পারেন। আমার রাজনীতিক বন্ধুরা বলে, তুমি আসলে কি তা রাজনীতিতে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। জনগণ তোমার সম্পর্কে কী ভাবছে বা তোমাকে কিভাবে দেখছে সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ধরে নাও, তুমি দরবেশ নও, তবুও লোকে তোমাকে দরবেশ মনে করে। রাজনীতিতে এটা একধরনের ধোঁকাবাজি। মানে বাইরের খোলসটাই আসল। বাংলাদেশে ১৬ কোটি মানুষ, সব দল মিলে রাজনীতির সাথে সরাসরি জড়িত মাত্র কয়েক লাখ মানুষ। বাকি সব মানুষ ভোটার। কেউ নৌকা আর কেউ ধানের শীষ। কেউ জিয়া আর কেউ শেখ মুজিব। দেশের মানুষকে দারিদ্র্যমুক্ত করতে এত সময় লাগার কথা নয়। কিন্তু দারিদ্র্য আমাদের ছেড়ে যাচ্ছে না। এর মানে আমাদের রাষ্ট্রনীতি ও সরকার ব্যবস্থাপনায় কোথাও গলদ রয়েছে। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, দণি কোরিয়া, তাইওয়ান, ভিয়েতনাম যদি সার্বিকভাবে উন্নতি করতে পারে তাহলে বাংলাদেশ পারে না কেন? এ ব্যাপারে ভাবার সময় এসে গেছে। আর দেরি করলে আমরা অন্ধকারে ডুবে যাব। এ কথা সত্যি, ইংরেজরা আমাদের ১৯০ বছর শোষণ করেছে। এ দেশের সম্পদ লুণ্ঠন করে লন্ডন নিয়ে গেছে। উইলিয়াম হান্টারের বই পড়লেই বুঝতে পারবেন এ দেশের সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে মুসলমানেরা কিভাবে শোষিত হয়েছে। এরপর পাকিস্তানের ২৩ বছরেও এ দেশের মানুষ শোষিত হয়েছে। বাংলাদেশের ৪০ বছরেও সাধারণ মানুষ সীমাহীনভাবে শোষিত হয়েছে। পুঁজির বিকাশের নামে একশ্রেণীর লোককে রাতারাতি নোংরা ধনীতে পরিণত করা হয়েছে। ১৯৮২ সালে ব্যাংক করার সময় মাত্র তিন কোটি টাকা জোগাড় করতে ২৫-২৬ জন উদ্যোক্তাকে জড়ো করতে হয়েছে। এর ভেতরেও কয়েকজন ভুয়া চেক দিয়ে ডিরেক্টর হয়েছে। তখন প্রশ্ন উঠেছিল আয়কর নিয়ে। সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে বলা হলো, যদি আয়করের বিষয় জানতে চাওয়া হয় তাহলে ব্যাংক হবে না। আয়করের বিষয়টা পরে দেখা যাবে। এভাবেই প্রথম প্রজন্মের ব্যাংকগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এখন এক হাজার কোটি মূলধন দিয়ে একা ব্যাংক করতে চান অনেকেই। চলতি সরকারও রাজনৈতিক কারণে কয়েকটি ব্যাংকের অনুমতি দিয়েছে। সমাজের সুবিধাভোগীদের সরকার নানাভাবে সহযোগিতা করে থাকেন। গরিব মানুষের জমি দখল করে কম দামে সুবিধাভোগীদের মাঝে বিতরণ করা। যে জমির দাম খোলাবাজারে এক কোটি টাকা তা সরকার বিক্রি করেন পাঁচ লাখ টাকায়। এর মানে নিজেদের লোককে রাতারাতি কোটিপতি বানিয়ে দেয়া।
১৯৭০ সালে যে শ্রমিকের মজুরি ছিল দৈনিক দুই টাকা তার মজুরি এখন ৩০০-৪০০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ওই একই যে মানুষটার মাসিক বেতন ৩০০-৪০০ টাকা ছিল এখন তার সম্পদের পরিমাণ পাঁচ হাজার কোটি। ব্যাংকের কেরানি হয়েছে ব্যাংকের চেয়ারম্যান। অবাঙালি ২২ পরিবারের পোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে আমরা দেশ স্বাধীন করেছি। এখন ২২ হাজার পরিবার আমাদের শোষণ করছে। এ শোষণের সাথে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোও জড়িত। বঙ্গবন্ধু সমাজতন্ত্র কায়েম করবেন বলেই ছোট ব্যবসায় থেকে বড় বড় শিল্পকারখানা জাতীয়করণ করেছিলেন। বেসরকারি খাতে পুঁজি বিনিয়োগকে তিনি নিরুৎসাহিত করেছেন। কিন্তু তিনি তা করতে পারেননি। তার সময়েই দুর্বল খাদ্য ব্যবস্থাপনার কারণে দেশে দুর্ভি হয়েছিল। দুঃখ করে তিনি বলেছিলেন, সবাই পায় সোনার খনি আর আমি পেয়েছি চোরের খনি। তার আমলেই সর্বোচ্চ পুঁজি বিনিয়োগের সীমা ছিল ১০ লাখ টাকা। দুই বছরের মাথায় সেই সীমা বাড়িয়ে তিন কোটি টাকা করতে হয়েছিল। রাষ্ট্রায়ত্ত সব কলকারখানায় সীমাহীন লুটপাট করেই একশ্রেণীর মানুষ পুঁজিপতি হয়েছিল। এসব পুঁজিপতির মূলধন এসেছিল লুটপাট থেকে। ’৭১ সালের ১৬ থেকে ১৮ ডিসেম্বর যারা বাংলাদেশ ব্যাংকের (সে সময়ের স্টেট ব্যাংক) টাকা লুট করেছিল তারাও আজ বিরাট শিল্পপতি এবং জাতিকে কিভাবে দেশের উন্নতি করতে হবে সে ব্যাপারে সবক দেয়। আমি ধন বা পুঁজি সৃষ্টির বিরুদ্ধে নই। কিন্তু রাষ্ট্র বা গরিব মানুষকে শোষণ করে নোংরা সম্পদের পাহাড় গড়ে তা কোনো সমাজব্যবস্থা চাইতে পারে না। বাংলাদেশের পুঁজিপতিরা এখন কাউকেই তোয়াক্কা করে না। কোথাও কোনো বাধা দেখলে বা এলে তাকে শক্তি দিয়ে প্রতিহত করে অথবা টাকা দিয়ে বশে আনে। সব ধনীর সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর সখ্য আছে। মতায় যে দলই আসুক তাতে তাদের কোনো অসুবিধা হয় না। ফলে রাষ্ট্র ধনীদের দাসে পরিণত হয়। একদিকে অভ্যন্তরীণ ধনীদের চাপ, অন্য দিকে বাইরের মতাবান রাষ্ট্রের চাপ। এই তো দেখুন এক সপ্তাহের মধ্যেই জাপন, ভারত ও আমেরিকার নেতারা বাংলাদেশ সফর করে গেলেন। সবাই বলছে, আমরা কিছু নিতে আসিনি, দিতে এসেছি। হিলারি তো প্রায় সবার সাথেই দেখা করেছেন। এমন গরিব দেশে বড় বড় মেহমানের আগমন সাধারণ মানুষের মনে নানারকম প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে।
পৃথিবীর শক্তিধর দেশ বলে বহুল পরিচিত আমেরিকাতেও মানুষ ফুটপাথে থাকে। তাদের কোনো কাজ নেই। তারা হোমলেস বলে পরিচিত। এ রকম লোক আছে কয়েক লাখ। সেই আমেরিকা বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাস আর যুদ্ধ করে বেড়াচ্ছে। কিন্তু কেন? শুধু আমেরিকার মতাবানদের রা করার জন্য। ওই দেশের কিছু কাগজ ও মিডিয়া আছে যারা প্রতি বছরই ধনীদের তালিকা করে। এসব তালিকায় বিল গেটসের মতো ভালো মানুষের নামও আছে। চলতি বছর বিল ধনীর তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে নেমে এসেছেন। প্রথম স্থানে আছেন মেক্সিকোর এক ভদ্রলোকের নাম। কিন্তু ওই মিডিয়াকে যদি বলা হয়, পৃথিবীর দরিদ্রতম মানুষটির নাম বলুন, তারা কি তা পারবেন? না পারবেন না। কারণ দরিদ্রতম মানুষ তো একজন বা একশ’ জন নন। কয়েক শ’ কোটি লোক দরিদ্রতম। এমনকি পৃথিবীতে দরিদ্রতম দেশের তালিকাও প্রকাশ করা হয়। যার মধ্যে আমাদের প্রিয়তম দেশটিও আছে। এক সময় আমাদের এই দেশটি সুজলা সুফলা ছিল। বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশ ছিল। সারা বিশ্বের সওদাগরেরা এ দেশে এসেছে ব্যবসায় করার জন্য। শেষ পর্যন্ত ইংরেজরা ব্যবসায়ের নাম করে এ দেশটি দখল করে নেয় এবং ১৯০ বছর ধরে লুণ্ঠন করে। অখণ্ড বাংলার লুণ্ঠিত সম্পদ দিয়ে লন্ডনকে গড়ে তোলে। বাংলার সম্পদ নিয়ে বিভিন্ন দেশে কলোনি গড়ে তোলে। নানা রঙ ও নানারূপে বিদেশীরা আবার আমাদের দেশে আসছে।
আমেরিকা যুদ্ধবাজ হিসেবে এখনো পৃথিবীর এক নম্বর দেশ। কিন্তু তার আর্থিক অবস্থা পতনের দিকে। শুনেছি শুধু চীনের কাছেই তার তিন ট্রিলিয়ন ডলার দেনা রয়েছে। এক সময় চীন আর আমেরিকার সম্পর্ক ছিল সাপে-নেউলে। বেশি দিন আগের কথা নয়, যখন চীন নিষিদ্ধ ছিল আমেরিকানদের জন্য। বেইজিং রেডিও ও চীনের মিডিয়া আমেরিকাকে বলত কাগুজে বাঘ। আজ চীনের মাল না হলে আমেরিকার চলে না। চীনের মতো দেশেও এখনো কোটি লোক দরিদ্র রয়ে গেছে। চীন নিজেও এটা স্বীকার করে। এই চীনকেও এখন অস্ত্র প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে। কারণ আমেরিকা চীনের জন্য একটি নিশ্চিত হুমকি। আমেরিকা চীনের বিরুদ্ধে তাইওয়ান, জাপান, ভারত, দণি কোরিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে ব্যবহার করতে চায়। ভারত রাশিয়ার সাথে বন্ধুত্বকে শীতল করে আমেরিকাকে বুকে টেনে নিচ্ছে। ভারতেও কোটি লোক প্রতিদিন খেতে পায় না। সে দেশ চীনের সাথে অস্ত্র প্রতিযোগিতায় নেমেছে। ভারতও পরিচালিত হয় নোংরা ধনের ইশারায়। রাজনীতি ও রাষ্ট্রকে ভারতের ধনীরা দাসে পরিণত করেছে। সেখানে ৩০ কোটি হরিজনকে (ভগবানের সন্তান) মানুষ হিসেবে গণ্য করা হয় না। ভারতের সোয়া শ’ কোটি লোকের ভেতর এক শ’ কোটি লোক দরিদ্র। বাকি ৯০ শতাংশ মধ্যবিত্ত। আর বাকিরা ধনী এবং তাদের ুৎপিপাসু। এমনিতরো ভারত প্রতিবেশী সব দেশকে ভীতসন্ত্রস্ত করে রেখেছে। শ্রীলঙ্কার মতো শান্তশিষ্ট দেশকেও ভারত অশান্ত করে রেখেছে। পাকিস্তানকে তো জন্মের পর থেকেই ভয়ভীতি দেখিয়ে চাপে রেখেছে। ভারতের ভয়কে মোকাবেলা করার জন্যই পাকিস্তান আণবিক বোমা তৈরি করতে বাধ্য হয়েছে। অথচ দরিদ্র দেশ দু’টির কোটি কোটি দরিদ্র মানুষকে মানবিক জীবনদান করার জন্য রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী ও ধনীরা কিছুই করেননি। ভারত ইতোমধ্যেই অস্ত্র কেনা বা আমদানির ব্যাপারে প্রথম স্থান দখল করেছে।
ইউরোপের অবস্থা দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। সুপ্রাচীন মহাশক্তিধর দেশ গ্রিস দেউলিয়া হয়ে গেছে। কিন্তু সে দেশে বহু ধনী আছেন এখনো যাদের বিত্তের কোনো অভাব নেই। আইসল্যান্ড দেশটিও বিক্রি হওয়ার পথে। কেন এ রকম হচ্ছে তা ভাবার জন্য অর্থনীতিবিদ, রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীদের সময় এসে গেছে। আমার তো মনে হচ্ছে বিশ্বনীতি রিফর্ম বা সংস্কার করার সময় এসে গেছে। প্রমাণিত হয়ে গেছে, দেশের বেশির ভাগ মানুষকে ভুখা রেখে পুঁজির বিকাশ বা শুধু যুদ্ধ করলে কোনো দেশ টিকবে না। আমরা এক বিশ্বের স্লোগান দেবো আর মানুষ হয়ে মানুষকে শোষণ করব এমন নীতি ভণ্ডামি ছাড়া আর কিছুই নয়। আমেরিকা আর ইউরোপের নেতারা মানবকল্যাণের স্লোগান দেয়, জাতিসঙ্ঘ তাদের সাথে সুর মিলিয়ে কথা বলে, পুঁজিপতিরা সরকারকে ব্ল্যাকমেইল করে, কথায় কথায় বিনা কারণে ভিনদেশকে আক্রমণের হুমকি দেয়। অথচ নিজ দেশের কোটি কোটি ভুখা ও বসতিহীন মানুষের কথা মনে রাখে না। এই নেতারাই গরিব মানুষকে খাদ্য না দিয়ে উদ্বৃত্ত খাদ্য সাগরে ফেলে দেয়। মানুষকে ভুখা রেখে খাদ্য সাগরে ফেলে দেয়া দানবীয় শক্তিরই কাজ। প্রখ্যাত দার্শনিক কার্ল মার্কস দরিদ্র মানুষের মুক্তির জন্য যে কথা বলেছিলেন তা কমিউনিস্ট নেতারা বাস্তবায়ন করতে পারেননি। নেতারা নিজেরাই বিলাসবহুল জীবনযাপন করতেন নিরাপত্তার নামে। সব সম্পদের মালিক রাষ্ট্র , এই স্লোগান দিয়ে সম্পদ সৃষ্টির ব্যাপারে মানুষের জন্মগত আকাক্সাকে পীড়ন করা হয়েছে। ওই চিন্তা ছিল মানুষের প্রকৃতিগত প্রজ্ঞা ও মেধার বিরুদ্ধে। মানুষকে চিরকালের জন্য বাধ্য করা যায় না। গণচীন সঠিক সময়ে নিজেদের গতিপথ পরিবর্তন করেছে। তাই চীন আজ এক শক্তিশালী অর্থনৈতিক শক্তি। আমেরিকার সাথে অস্ত্রের প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে রাশিয়া মানুষের মৌলিক অধিকারের কথা ভুলে গিয়েছিল।
বাজেট নিয়ে লিখতে গিয়ে গত সপ্তাহে আমি বাংলাদেশের উন্নয়ন দর্শন নিয়ে কিছু কথা বলেছি। আমাদের অর্থনীতি যেভাবে চলছে তাতে গরিব হতদরিদ্র মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকবে। কাগজে-কলমে গরিবের পে কথা বলা আমরা শুনতে পাচ্ছি গত এক শ’ বছর ধরে। রাজনীতি আর ভাঁওতাবাজির জন্য কথাগুলো ঠিক আছে। যদি পাঁচ বছর সংসদ সদস্য থাকলে একটি লোক ধনী হতে পারে তাহলে গরিব মানুষগুলোর ভাগ্য এক শ’ বছরেও পরিবর্তন হচ্ছে না কেন। যদি ব্যবসায়ীরা বছরে ২০-৩০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেয় রাষ্ট্রকে হাত করে সেখানে গরিবের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে কোন পথে। রাষ্ট্র, সরকার, সংসদ, বুদ্ধিজীবী ও শিতি মানুষের মগজ ধোলাই করার সময় এসে গেছে। তা না হলে ১৬ কোটি মানুষের ভেতর ১৪ কোটিকে দরিদ্র রেখে দেশের উন্নতি কখনোই হবে না। একইভাবে বিশ্বের সাত শ’ কোটি মানুষের মধ্যে ছয় শ’ কোটি মানুষকে অভুক্ত বা অধিকারহারা রেখে এ বিশ্বের মুক্তি হবে না। তাই আমি বলছি বিশ্বের ছয় শ’ কোটি মানুষই একাট্টা হয়ে একজন দরিদ্রতম ব্যক্তি যার বা যাদের সম্পদ রাষ্ট্র এবং ধনীরা জোর করে নিয়ে নিজেরা ভোগ করছে আর সন্ত্রাসী কায়দায় দরিদ্রদের সন্ত্রস্ত করে রেখেছে। 
লেখক : কবি ও সাংবাদিক
ershadmz40@yahoo.com

শনিবার, ৫ মে, ২০১২

বাজেট কেন এবং কাদের জন্য




॥ এরশাদ মজুমদার ॥

আমি অর্থনীতিবিদ নই। বাজেট প্রণয়নকারী বিশেষজ্ঞও নই। তবে সাংবাদিক হিসেবে দীর্ঘকাল ধরে বাজেট নিয়ে কাজ করেছি। এ ছাড়া দেশের উন্নয়নে আমার নিজস্ব একটি চিন্তা ও ধারণা আছে। আমাদের চলমান বাজেটব্যবস্থা কখনোই দেশের সব মানুষের এক শ’ ভাগ কল্যাণ বা উন্নয়ন সাধন করতে পারবে না। বাজেট রচনা বা প্রণয়নে যারা মাথা ঘামান বা রাতদিন পরিশ্রম করেন, তারা গতানুগতিকভাবেই তা তৈরি করেন। ব্রিটিশ বা পাকিস্তানি আমলের সাথে চলমান বাজেট তৈরির প্রক্রিয়ার কোনো বড় ফারাক নেই। একেবারেই সেকেলে ঘুণেধরা ব্যবস্থা। আমাদের বাজেট প্রণয়ন পদ্ধতি বা ব্যবস্থা না ধনতান্ত্রিক, না সমাজতান্ত্রিক, না ইসলামিক। একটা জগাখিচুড়ি। বর্তমান অর্থমন্ত্রী একজন সাবেক আমলা। তিরিশ বছর বা তারও বেশি সময় পাকিস্তান ও বাংলাদেশ সরকারের খেদমত করেছেন আমলা হিসেবে। পাকিস্তান বা ব্রিটিশ আমলে বহু বাঙালি মুসলমান রাজনীতিক ইচ্ছা করলে বড় আমলা হতে পারতেন। যেমন ধরুন, শেরেবাংলা, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, স্যার খাজা নাজিমুদ্দিন, মৌলবী তমিজউদ্দিন, নূরুল আমিন প্রমুখ। তারা সবাই মেধাবী ছিলেন। কিন্তু আমলা না হয়ে রাজনীতিতে এসেছেন দেশের সেবা করার জন্য।
তৎকালীন পূর্ববাংলা ও বর্তমান বাংলাদেশে জমিদারিব্যবস্থা উচ্ছেদ করা হয়েছে ১৯৫০ সালে মুসলিম লীগ আমলে। সরকারের এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন বড় বড় জমিদার বাবু, যারা সমাজে প্রগতিশীল বলে পরিচিত ছিলেন। জিন্নাহ সাহেব একবার বলেছিলেন, পাকিস্তানের প্রয়োজন পূর্ববঙ্গের গরিব মুসলমান কৃষকদের মুক্তির জন্য। এর মানে, পূর্ববঙ্গের মুসলমানেরা এত বেশি শোষিত হয়েছে যে, তাদের মুক্তির জন্য পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল। যদিও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ও পূর্ববঙ্গের মুসলিম লীগ নেতারা সে কথা ভুলে গিয়েছিলেন। জমিদারিব্যবস্থা বাতিল বা উচ্ছেদ করাটা ছিল একটি বিপ্লবী পদপে, যার প্রশংসা করেছিল রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি। পূর্ববঙ্গের বেশির ভাগ জমিদারই ছিলেন হিন্দু এবং তারা ছিলেন কলকাতার অধিবাসী। শুনেছি ১৯৫৭ সালে যুক্তফ্রন্ট, যার অন্যতম শরিক ছিল আওয়ামী লীগ, মতায় থাকাকালে জমিদার বাবুরা মুসলিম লীগের ওই বিপ্লবী পদেেপর বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন। এ কথা আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, যুক্তফ্রন্ট গঠনের সময় তাতে যোগ দিয়েছিল কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট পার্টি। জমিদার বাবুদের অনেকেই কংগ্রেস করতেন। মুসলিম লীগ যে এমন একটি বিপ্লবী কাজ করতে পারে, তা কংগ্রেসি জমিদার বাবুরা বিশ্বাস করতে পারেননি। এই মুসলিম লীগই মুসলমান প্রজাদের ঋণের বোঝা থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য ঋণ সালিশি বোর্ড গঠন করেছিল, যা শেরেবাংলা বাস্তবায়ন করেছিলেন। বিষয়টি উল্লেখ করলাম আমাদের নতুন প্রজন্মের জন্য। মুসলিম লীগের মতো একটি দণিপন্থী রাজনৈতিক দলও সাধারণ মানুষের মুক্তির জন্য এমন একটি প্রগতিশীল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিল। বাংলাদেশে এখন মুসলিম লীগ নেই বললেই চলে। তবে আমি নিজেও মনে করি, মুসলিম লীগ কখনোই গণমানুষের রাজনৈতিক দল ছিল না। যদিও মুসলিম লীগকে নির্যাতিত মুসলিম জনসাধারণ সমর্থন দিয়েছিল সময়ের চাহিদার কারণে।
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন রোজ গার্ডেনে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে মুসলিম লীগবিরোধী রাজনৈতিক দল আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়। মওলানা সাহেব বলতেন, আমরা হলাম জনগণের মুসলিম লীগ, আর শুধু মুসলিম লীগ হলো খাজাগজার দল। আওয়ামী মুসলিম লীগে যারা যোগ দিয়েছিলেন তারা সবাই ছিলেন সাধারণ মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের মানুষ। মুসলিম লীগ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করেছে এই দম্ভেই আত্মহারা ছিল। ফলে ’৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগেই দলটি জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। মওলানা ভাসানী শেরেবাংলা ও সোহরাওয়ার্দীকে নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন করলেন, যা মুসলিম লীগকে পূর্ববঙ্গের রাজনীতি থেকে বিদায় দেয়। তারপর মুসলিম লীগ এ দেশের রাজনীতিতে আর ফিরে আসতে পারেনি। রাজনীতি থেকে শেরওয়ানি, চোস্ত পাজামা আর জিন্নাহ টুপি বিদায় নিলো; এলো লুঙ্গি, শার্ট, পাজামা, পাঞ্জাবি। রাজনীতি উকিল-মোক্তার, জমিদার-জোতদার, তালুকদারদের চেম্বার ও কাচারিঘর থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল অতি মধ্যবিত্তের দুয়ারে। এখন রাজনীতি বাংলাদেশের ঘরে ঘরে। বাঙালিরা, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণী রাজনীতি না করে থাকতে পারে না। এখন রিকশাচলক, ফেরিওয়ালাও সংবিধানের কথা বলে। গ্রাম, আধা শহর ও পুরো শহরে মধ্যবিত্তরা চায়ের কাপে রাজনীতির ঝড় তোলে। দুই টাকার কাগজ না পড়লে তাদের ভাতই হজম হয় না।
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ৪০ বছর পার হয়ে গেছে। মধ্যবিত্তের রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ’৭২ সালে ব্যাংকের কেরানি বা কার্ক ছিলেন এমন ব্যক্তি এখন ব্যাংকের চেয়ারম্যান হয়েছেন। আমদানি অফিসের কেরানি এখন পাঁচ হাজার কোটি টাকার শিল্প গ্রুপের মালিক। ’৭২ সালে যেখানে এক কাঠা জমির দাম দুই হাজার টাকা ছিল, তা এখন দুই কোটি টাকা। রাজউক বা ডিআইটি যে জমি পাঁচ হাজার টাকায় বরাদ্দ দিয়েছিল তা এখন এক শ’ কোটি টাকা। সরকারি সহযোগিতা বা অনুকম্পা পেয়ে যারা সরকারি জমি পেয়েছেন তারা রাতারাতি ধনী হয়ে গেছেন। ’৮২ সালে একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করতে তিন কোটি টাকা লেগেছে উদ্যোক্তাদের। সেই তিন কোটি টাকা জোগাড় করতে ২৫-২৬ জন উদ্যোক্তার প্রয়োজন হয়েছে। এখন একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করতে চার শ’ কোটি টাকা লাগবে। অনুমতি পাওয়ার জন্য আরো চার-পাঁচ শ’ কোটি টাকা লাগে বলে শুনেছি। এমন উদ্যোক্তাও আছেন যিনি একাই এক হাজার কোটি টাকা দিয়ে ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করতে চান। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, রাজনৈতিক কারণে নতুন ব্যাংকের অনুমতি দেয়া হচ্ছে। যাদের ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়া হচ্ছে তারা তা বিক্রি করে হয়তো পাবেন এক শ’ কোটি টাকা। রাজউক এত দিন পর বলছে, এখন থেকে আর জমি বরাদ্দ দেয়া হবে না। এখন মধ্যবিত্তদের ফ্যাট বরাদ্দ দেয়া হবে। জানি না রাজউকের এ ওয়াদা কতটুকু সত্য হবে। রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের ভালোবাসার মানুষদের ধনী বানানোর এর চেয়ে সহজ পথ আর কোথায় পাবে।
রাজধানীর চার দিকে এখন নদী দখল চলছে। এই দখলি ব্যবসায় করছেন রাজনৈতিক আশ্রয়ে পরিপুষ্ট শক্তিধর ব্যক্তিরা। গরিব মানুষের জমি দখল করে রাজউক এবং ধনীরা প্লট বানিয়ে বিক্রি করছেন। আপনারা প্রতিদিন খবরের কাগজে ও টিভিতে জমি বিক্রির বিজ্ঞাপন দেখেন। নামমাত্র মূল্যে জমি দখল করে সেই জমি হাজার কোটি টাকায় বিক্রি হচ্ছে। রাজধানীর চার দিকে এখন শুধু হাউজিংয়ের বিজ্ঞাপন। পত্রিকাওয়ালারাও বেশ খুশি। যত বেশি রঙিন বিজ্ঞাপন তত বেশি টাকা। খুবই আনন্দের খবর। একটা সময় ছিল যখন পত্রিকার প্রথম পাতায় চব্বিশ ইঞ্চির বেশি বিজ্ঞাপন ছাপা হতো না। পাঠকের অধিকার বলেও তো একটি কথা আছে। এখন পাঠকদের সেই অধিকার নেই। সাংবাদিকেরা বলবেন, আমরা শ্রমিক মানুষ, ভালো বেতন পেলেই খুশি। পত্রিকা যদি বেশি বেশি বিজ্ঞাপন না পায়, তাহলে আমাদের অষ্টম ওয়েজবোর্ড দেবে কোত্থেকে। আগেই বলেছি, রাজনীতি এখন মধ্যবিত্তের দুয়ারে। ধনীরা রাজনৈতিক দলগুলোকে ভালোবেসে চুমা খায়। চাওয়া মাত্রই টাকা দেয়। সরকারে থাকলে মাসে পাঁচ শ’ কোটি, আর বিরোধী দলে থাকলে মাসে পঞ্চাশ কোটি। এবার আপনারাই বলুন, বেচারা রাজনৈতিক দলগুলো টাকার এই ভালোবাসাকে কিভাবে উপো করবে। গ্রামগঞ্জে, হাটবাজারে চাঁদাবাজির এই ব্যবস্থা ছড়িয়ে পড়েছে। মতাসীন দলের ইউনিয়ন নেতারও মাসে লাখখানেক টাকা চাঁদা আদায় হয়। যদি কখনো প্রশ্ন করেন, ভাই কেমন আছেন? ভাই উত্তরে বলবেন, বোঝেনই তো দল মতায় থাকলে যা হয়। সারা দিন ব্যস্ত থাকতে হয়। ব্যবসায়-বাণিজ্য কিছু করছেন নাকি? সময় কোথায় বলুন? তা হলে? দল চালাতে হলে তো কিছু চাঁদা নিতেই হয়। জনসাধারণ ভালোবেসেই মাসে মাসে কিছু টাকা দেয়। এ ছাড়া আমাদের ছেলেরাই তো উন্নয়নের কাজ করছে। টেন্ডারগুলো তারাই পায়। বুঝতেই তো পারেন রাজনীতি করতে হলে এসব তো করতে হবে।
রাজধানীর পর্যায়ে চাঁদাবাজির কথা আগেই বলেছি। এ ছাড়া রাজনীতিতে উপরি পাওনা তো আছেই। সুরঞ্জিত বাবুর গল্প তো আপনারা জানতেই পেরেছেন। ওনার ছেলেও ছয় মাস চাকরি করে পাঁচ কোটি টাকা জমা দিয়ে টেলি ব্যবসায় জোগাড় করেছেন। তিনি দুদকে জবানবন্দি দিয়ে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, বন্ধুরা তাকে টাকা দিয়েছেন। সুরঞ্জিত বাবুর ছেলের মতো এ দেশে আরো বহু ছেলে আছে, যাদের বন্ধুরা সরকারি ব্যবসা পাওয়ার জন্য এভাবে টাকা দেয় না। কারণ, তাদের বাবা মন্ত্রী নন। শুনেছি এ জামানায় সংসদ সদস্য হতে নির্বাচনে চার-পাঁচ কোটি টাকা খরচ করতে হয়। মন্ত্রিত্ব পেতেও নিশ্চয়ই টাকা খরচ করতে হয়। দল যদি নির্বাচন করতে হাজার কোটি টাকা খরচ করে, সে টাকা দলনেতা কোথায় পাবেন? বাধ্য হয়েই দলনেতাকে বড় বড় ব্যবসায়ীর কাছে ওয়াদা করতে হয়Ñ মতায় গেলে পুষিয়ে দেবো। পদ্মা সেতুর ঘটনাটা হয়তো তেমনি একটা কিছু। তাই ব্যবসায়ী আবুল সাহেবকে কিছু করা যায়নি। সুরঞ্জিত বাবুর ঘটনাটা একটু ভাবুন। তার ওজারতি গিয়েও যায়নি। তিনি এখন উজিরে খামাখা। এর মানে হলো দপ্তরবিহীন মন্ত্রী। উর্দুতে বলে উজিরে খামাখা। মানে কাজ নেই, নিয়মিত সরকারি তহবিল থেকে টাকা-পয়সা নিয়ে সংসার চালাবেন।
আমাদের দেশের দুর্নীতি সম্পর্কে টিআইবি (ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ) বহু দিন ধরে প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে। সে প্রতিবেদন আমাদের জন্য মর্যাদার কিছু নয়। এতে বিশ্ববাসীর কাছে আমাদের মাথা হেঁট হয়ে যায়। তবে দুর্নীতির বিষয়টি এখন আর কেউ গায়ে মাখে না। সরকারি অফিসের পিয়ন থেকে সচিব-মন্ত্রী পর্যন্ত সবাই পদমর্যাদার খাজনা, সেলামি বা সম্মানী আদায় করেন। ছেলেবেলায় চাপরাশিবাড়ির কথা শুনেছি। এটি একটি সরকারি চাকরি। চাপরাশির চাকরি করে ভদ্রলোক আয়-রোজগার করে সমাজে সম্মান অর্জন করেছিলেন। এমনকি সারা জীবন উমেদারের চাকরি করেও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করেছেন এমন লোক ছিল। উমেদার হচ্ছেন, যিনি চাকরির জন্য আবেদন করেছেন, এখনো পাননি। কিন্তু বিনাবেতনে বা বিনেপয়সায় কাজ করছেন বা শিখছেন। উমেদারকেও লোকে খুশি হয়ে দু-চার পয়সা হাতে গুঁজে দিত। এ তো গেল সরকারি অফিসের উপরি লেনদেনের কিসসা। আপনারা ইতোমধ্যেই জানতে পেরেছেন, আগামী বাজেটের সাইজ হবে এক লাখ আশি হাজার কোটি টাকা। সরকারি কর্মচারীরা যদি মাত্র দশ পার্সেন্ট করে উপরি গ্রহণ করেন, তাহলে তার পরিমাণ হবে বছরে ১৮ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশে উপরি আদায়ের পরিমাণ বা পার্সেন্টেজ আপনারা নিশ্চয়ই জানেন। আমি তো বলি, দশ পার্সেন্ট হাতখরচ জাতি দিতেই পারে। ছেলেবেলায় শুনেছি, যে বাজার করে সে পান বিড়ির জন্য দু-চার পয়সা রাখত। শুনেছি, করাচিতে বাসাবাড়ির বাঙালি কেয়ারটেকাররা শর্ত দিত, বাজার করার সুযোগ দিতে হবে। বড় বড় হোটেল বা রেস্টুরেন্টে টিপস দেয়া একটা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। কোনো হোটেলে টিপস বিলের সাথে যোগ করে দেয়া হয়। একসময় এই টিপসকে বখশিশ বলা হতো।
এতণ ধরে আপনাদের কাছে স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনীতির পারিপার্শ্বিক অবস্থার কথা বলেছি। আমার মূল আলোচনা হচ্ছে বাজেট নিয়ে। আমাদের সবার জীবনেই বাজেট আছে। যারা চাকরি করেন তারা বেতন এবং উপরি, বাড়তি বা ঘুষ নিয়ে মাসিক বাজেট করেন। বড় বড় ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, জমির ডেভেলপাররা সংসার খরচের জন্য তেমন বাজেট তৈরি করেন না। কারণ তাদের কাছে প্রচুর টাকা থাকে। সে টাকা ব্যাংকের বা ব্যবসায়ের। এ ব্যাপারে মরহুম সাইফুর রহমান সাহেব বলতেন, শিল্প বা ব্যবসায়ের অবস্থা খারাপ। কিন্তু মালিকের অবস্থা খুবই ভালো। তারা পাজেরো বা বিএমডব্লিউতে চড়েন। বড় বড় ভিলা বানান। কর্মচারীর বেতন ঠিক সময় দেন না। একইভাবে সরকারও বাজেট তৈরি করে রাজস্ব আদায়, বিদেশী ঋণ, দেশী ঋণের ওপর নির্ভর করে। ইদানীং বিদেশী ঋণের পরিমাণ অনেক কমে গেছে। পুরনো বিদেশী ঋণ অনেক বাকি পড়ে গেছে। নিয়মিত কিস্তি শোধ হচ্ছে না। চলতি সরকার মনের মাধুরী মিশিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সরকার চালাচ্ছে। ডিপোজিটের ওপর সুদের হার ঠিক নেই। জনসাধারণ সরকারি প্রতিষ্ঠানে এখন আর সঞ্চয় রাখতে চায় না। এক লাখ আশি হাজার কোটি টাকার বাজেটের মধ্যে সরকারের কর্মচারীর বেতন, রণাবেণ, পেনশনবাবদই খরচ হয় বেশির ভাগ টাকা। এর মানে হচ্ছেÑ এক শ’ টাকার ব্যবসায় চালাতে গিয়ে ম্যানেজারের বেতন দিতে হয় দেড় শ’ টাকা। তাহলেই বুঝতে পারেন, এ ব্যবসায় কত দিন চলবে। সরকারের সাইজও দিন দিন বেড়ে চলেছে। ১-১১-এর সরকারের দিকে একবার নজর দিন। সরকারের বেতনভুক কর্মচারীরাই সরকার দখল করে দুই বছর দেশবাসীকে হেনস্তা করেছেন। এখন তারা দেশত্যাগী হয়েছেন। যাওয়ার সময় গণতন্ত্রের জোব্বা পরিয়ে আওয়ামী লীগকে মতায় বসিয়ে দিয়ে গেছেন। মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীনের কাছ থেকে ২৪০ সিট নিয়ে আওয়ামী লীগ এখন মতায়। বলা যেতে পারে ১-১১-এর সরকারের বৈধ ওয়ারিশ হচ্ছে আওয়ামী লীগ। গণতন্ত্র আর দেশ রার জন্য এখন আওয়ামী লীগ ও সরকার লড়াই করে যাচ্ছে পুলিশ, বিজিবি আর র‌্যাবের মাধ্যমে। তাই আমরা প্রতিদিন টিভিতে পুলিশ আর র‌্যাবের বক্তৃতা শুনি।
প্রশ্ন হলোÑ বাজেটের বেনিফিট কাদের কাছে পৌঁছে? কারা বেনিফিসিয়ারি তা ইতোমধ্যে আপনারা কিছুটা আঁচ করতে পেরেছেন। একজন চৌকিদারও এই বাজেটের বেনিফিট পান। পান না শুধু এ দেশের কোটি কোটি সাধারণ কৃষক ও কৃষি উৎপাদক শ্রেণী। এ দেশে কৃষকদের কোনো শক্তিশালী সংগঠন নেই। কৃষক ছাড়া বাকি সবার দরকষাকষির সংগঠন আছে। দেশে লাখ লাখ মানুষ আছেন, যারা কখনো টাকা দেখেন না বা তাদের টাকার (কারেন্সি) প্রয়োজন হয় না। তারা শ্রমের বিনিময়ে চাল পান, দুপুরের খাবার পান। ধানের চাতালে যে সব মা-বোন কাজ করেন, তারা দিনের শেষে মজুরি হিসেবে চাল পান। বর্গা আর প্রান্তিক চাষিদের অবস্থা খুবই শোচনীয়। বড় চাষি বা কৃষক বা জমির মালিকেরা শুধু চাষের ওপর নির্ভর করেন না, তাদের আরো অনেক ব্যবসায় আছে। তাদেরই শিতি ছেলেমেয়েরা চাকরি করেন। তাদের হাতে নগদ অর্থ থাকে। আমাদের অর্থনীতি এখনো কৃষি ও কৃষকদের পে নয়। ফলে সরকারের বা রাজনৈতিক দলগুলোর দর্শন, আদর্শ ও কর্মসূচি কৃষকদের পে নয়। বহু বছর আগে জিয়া সাহেবের আমলে যখন আজিজুল হক সাহেব কৃষি উপদেষ্টা ছিলেন, তখন কৃষি মন্ত্রণালয়ের একটি কমিটি আমাকে প্রশ্ন করেছিলÑ আমি কৃষির পে না কৃষকের প।ে কমিটি আমাকে জানাল, সরকার কৃষি বা খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কাজ করছে। আপনার কাগজ তো কৃষকদের স্বার্থের জন্য কাজ করছে। আমরা মনে করি আপনি কৃষকদের উসকানি দিচ্ছেন। এই তথ্য থেকেই আপনারা বুঝতে পারছেন, বাংলাদেশ সরকারের আদর্শ কী এবং কোন পথে। পাকিস্তানের ২৩ বছর আর বাংলাদেশের ৪০ বছর মিলিয়ে ৬৩ বছর পার হতে চলেছে। কিন্তু কৃষকদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। ফলে দেশের যে উন্নতি ও অগ্রগতি হওয়ার কথা ছিল, তা হয়নি। কৃষকদের সজাগ করার জন্য কাজ করে অনেকেই সরকারি পুরস্কার পান। কৃষি এখনো দেশের ৬০ ভাগ মানুষের কর্মসংস্থান করে। এর মানে হলোÑ কোন পথ অবলম্বন করলে দেশের অর্থনীতি স্বাধীন হবে, সে পথে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো চলছে না। আপনারা ইতোমধ্যেই জানতে পেরেছেন বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। ফলে ধানের দাম একেবারেই পড়ে গেছে। লাভ হবে মিল মালিক ও কৃষিপণ্যে বিনিয়োগকারীদের। শোনা যাচ্ছে, কৃষকেরা এবার সর্বস্বান্ত হবেন। বেশি উৎপাদন একটি মহা আনন্দের খবর হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু হয়েছে বেদনার খবর। বেশি ফলন আমাদের কৃষকদের বহুকাল থেকে কষ্ট দিচ্ছে শুধু সরকারের নীতির ফলে। পৃথিবীর বহু দেশ এ সমস্যার সমাধান করেছে কৃষকদের কল্যাণার্থে। সে সব দেশের অর্থনীতিও বিকশিত হয়েছে কৃষকদের সমর্থনে। জাপান পৃথিবীর অন্যতম প্রধান শিল্পোন্নত দেশ হওয়া সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক চাপের মুখেও কৃষি ত্যাগ করেনি। নয়া কৃষিনীতির কারণে জাপানের কৃষকেরা এখন খুবই সুখে আছেন। জাপানের এক শ’ ভাগ কৃষকই এখন আধুনিক শিল্পপণ্যের ভোক্তা। কৃষিতে যত বেশি ভর্তুকি, তত বেশি শিল্পের বিকাশ। জাপান ও ভিয়েতনামের কৃষকেরা এখন সবচেয়ে সম্মানিত নাগরিক। আমাদের দেশের কৃষকদের কোনো সম্মান নেই। কারণ তারা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী নন। সুতরাং এই বাজেটের সাথে কৃষকদের কোনো সম্পর্ক নেই। চলমান সরকার ও রাজনৈতিকব্যবস্থা কৃষকদের মিত্র নয়। দেশের ষোলো বা পনেরো কোটি মানুষের ভেতর দুই-তিন কোটির সম্পর্ক রয়েছে বাজেটের সাথে। এমন ধরনের বাজেট হাজার বছরেও কৃষকের কল্যাণ বয়ে আনবে না। 
লেখক : কবি ও সাংবাদিক
ershadmz40@yahoo.com