॥ এরশাদ মজুমদার ॥
পৃথিবীর দারিদ্রতম মানুষটি কে এ বিষয়ে আমার কোনো চিন্তাভাবনা কখনোই ছিল না। আমার মুরব্বি বিশিষ্ট ব্যাংকার মুজিবুল হায়দার চৌধুরী চিন্তাটি আমার মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু এ ব্যাপারে কোথাও কোনো তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায়নি। দারিদ্র্য নিয়ে আমাদের রাজনীতিক, অর্থনীতিক, দার্শনিক আর চিন্তকদের চিন্তার আর গবেষণার শেষ নেই। দরিদ্র কাকে বলে, দারিদ্র্য কত প্রকার, কী হলে একজন মানুষকে দরিদ্র বলা যাবে এসব কথা বলা হয়ে গেছে। শত শত বই লেখা হয়ে গেছে। ধনী দেশগুলো নানাভাবে দরিদ্র দেশগুলোকে ঋণ দিচ্ছে, সাহায্য দিচ্ছে। কিন্তু পৃথিবীর দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কমছে না। ৭০০ কোটি মানুষের এ পৃথিবীতে ৫০০ কোটি মানুষ দরিদ্র বা হতদরিদ্র। বিশ্বব্যাংকের বদৌলতে আমরা ইতোমধ্যে বহু নতুন শব্দ জানতে ও শিখতে পেরেছি। লেখক, সাংবাদিক, গবেষক, বুদ্ধিজীবীরা নিয়মিত বা হরহামেশা এসব শব্দ ব্যবহার করছেন। গত ৬৩ বছর ধরে আমরা দারিদ্র্যের কথা শুনে আসছি। দারিদ্র্য কমানোর জন্য কোথাও কারো কোনো চেষ্টার ত্রুটি নেই। কিন্তু দারিদ্র্য কমে না। এর রহস্য কী, কে বলতে পারবে? আমাদের প্রিয় পৃথিবীটা কি তাহলে একদিন এমন বিশাল দারিদ্র্য নিয়েই বিলীন হয়ে যাবে? আমার তো মনে হয় না এ জীবনে দারিদ্র্যমুক্ত একটি পৃথিবী দেখে যেতে পারব।
পৃথিবীতে এখনো যে সম্পদ আছে তার পূর্ণাঙ্গ ব্যবহার হয়নি। যেটুকু সম্পদ ব্যবহার হচ্ছে তার ৯৯ শতাংশেই চলে যাচ্ছে ধনী ও মতাবানদের কাছে। মতাবান আর ধনী দেশগুলো এ জনসম্পদ দিয়ে কী করছে? বেশির ভাগ উদ্বৃত্ত সম্পদ ব্যবহার হচ্ছে যুদ্ধে, সাধারণ মানুষকে হত্যা করার জন্য। সম্প্রতি ইউরোপ ও আমেরিকায় অকুপাই আন্দোলন হয়েছে। এ আন্দোলনে বহু মানুষ আহত ও নিহত হয়েছে। অকুপাই আন্দোলনের নেতাদের দাবি ছিল পৃথিবীর ৯৯ শতাংশ সম্পদের মালিকানা চলে গেছে এক ভাগ মানুষের কাছে। সেই এক ভাগ মানুষই পৃথিবীটাকে চালাচ্ছে। জগৎব্যাপী অশান্তি সৃষ্টি করে রেখেছে। তারাই জাতিসঙ্ঘকে নিয়ন্ত্রণ করে। জাতিসঙ্ঘ তাদেরই কথামতো চলে। জাতিসঙ্ঘই যুদ্ধের অনুমতি দেয়। আফগানিস্তানে যুদ্ধ চলছে অনেক বছর ধরে। এ যুদ্ধের কারণ কী, কেন এ যুদ্ধ চলছে কেউ বলতে পারে না। যুদ্ধের ফলাফল কী হবে তা আমরা সবাই জানি। ওবামা প্রশাসন এখন তালেবানদের সাথে আলোচনা শুরু করেছে। এই তো ৩০-৪০ বছর আগেও পৃথিবীর অবস্থা এমন ছিল না। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আমেরিকা এবং তার দোসররা এমন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে, যখন খুশি যেখানে সেখানে যুদ্ধ বাধিয়ে দিচ্ছে। এক সময় আমেরিকা এবং তার মিত্ররা কমিউনিজমকে ধ্বংস বা প্রতিহত করার জন্য লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে। তখন ইসলাম বা বেকুব মুসলমানেরা ছিল তাদের বন্ধু। কমিউনিজম দমনের জন্য মুসলমানেরা অন্ধের মতো পশ্চিমাদের সমর্থন করেছে। আজ সেই পশ্চিমারাই সন্ত্রাস দমনের নামে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। তাদের এই যুদ্ধে বাংলাদেশের সরকারগুলোও সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের একশ্রেণীর বামপন্থী আর বুদ্ধিজীবীরা আমেরিকার এই ভাঁওতাবাজিকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। সন্ত্রাস দমনের নামে ইসলামকে ধ্বংস করার এ উদ্যোগকে সমর্থন করার জন্য বিভিন্ন দেশকে আমেরিকা অর্থসাহায্য দিচ্ছে।
ক’দিন আগে নোবেল বিজয়ী জার্মান কবি গুন্টার গ্রাস একটি কবিতা লিখে পৃথিবীকে কাঁপিয়ে দিয়েছেন। মনের যাতনায় জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তিনি এই কবিতা লিখেছেন। সারা বিশ্বের বিখ্যাত কাগজগুলো তার ওই কবিতার অনুবাদ প্রকাশ করে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। আমিও উদ্বুদ্ধ হয়ে তার সেই কবিতা অনুবাদ করেছি। এই মহান কবি বলেছেন, সত্য কথা না বলে এতদিন চুপ থাকার জন্য তিনি এখন অনুতপ্ত। তিনি নিজেকে অপরাধী সাব্যস্ত করে নিন্দা করেছেন। গ্রাস তার কবিতায় যে সত্য কথাটি তুলে ধরেছেন তা হলো, ইসরাইলের কাছে আণবিক বোমা আছে, কিন্তু তা নিয়ে শক্তিধরেরা কোনো উচ্চবাচ্য করছে না। ইরান আণবিক বোমা তৈরি করছে এই সন্দেহে ইরানের বিরুদ্ধে নানা রকম ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। গ্রাস এ ব্যাপারে নিজের দেশ জার্মানিরও সমালোচনা করেছেন। বিশ্বের চলমান অশান্তির জন্য গ্রাস শক্তিধর দেশগুলোকে দায়ী করেছেন। মতার লড়াই ও অন্যকে নিজের প্রভাবে রাখা হাজার বছর আগেও ছিল। বিশ্ব জয় করে সেকান্দর বাদশাহ বা আলেক্সান্ডার ‘গ্রেট’ টাইটেল পেয়েছিলেন। একসময় বলা হতো বীরভোগ্যা বসুন্ধরা। বা জোর যার মুল্লুক তার। সেসব যুগ বা শতাব্দী পেরিয়ে মানুষ নাকি সভ্য হয়েছে। বিশ্বসভ্য হয়েছে এ ধারণাটা একেবারেই মিথ্যা। পুরো বিশ্বটাকে নিজেদের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য আমেরিকা তার পদলেহী দোসরেরা ভয়ভীতি দেখিয়ে দমন করে রেখেছে। আপনারা নিজেরাই দেখছেন, বাংলাদেশ গরিব ও দুর্বল হওয়ার কারণে শক্তিশালী দেশগুলো কী ধরনে ব্যবহার করছে। সত্যি কথা বলতে কী চলমান বিশ্বের অবস্থা দেখে আমার হয় না আমরা সভ্যজগতে বাস করছে।
শত চেষ্টা করেও আমরা গত ৬৩ বছরে আমরা দেশের মানুষকে দারিদ্র্যের ভয়াল অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে পারেননি। কারণ আমাদের রাজনীতিক ও আমলারা সাধারণ মানুষের উন্নতির দর্শনে বিশ্বাস করেন না। কৃষক শ্রমিকদের নিয়ে রাজনীতি আমাদের দেশে খুবই জনপ্রিয়। এতে অতি অল্প সময়ে রাজনীতিকেরা জনপ্রিয় হতে পারেন। আমার রাজনীতিক বন্ধুরা বলে, তুমি আসলে কি তা রাজনীতিতে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। জনগণ তোমার সম্পর্কে কী ভাবছে বা তোমাকে কিভাবে দেখছে সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ধরে নাও, তুমি দরবেশ নও, তবুও লোকে তোমাকে দরবেশ মনে করে। রাজনীতিতে এটা একধরনের ধোঁকাবাজি। মানে বাইরের খোলসটাই আসল। বাংলাদেশে ১৬ কোটি মানুষ, সব দল মিলে রাজনীতির সাথে সরাসরি জড়িত মাত্র কয়েক লাখ মানুষ। বাকি সব মানুষ ভোটার। কেউ নৌকা আর কেউ ধানের শীষ। কেউ জিয়া আর কেউ শেখ মুজিব। দেশের মানুষকে দারিদ্র্যমুক্ত করতে এত সময় লাগার কথা নয়। কিন্তু দারিদ্র্য আমাদের ছেড়ে যাচ্ছে না। এর মানে আমাদের রাষ্ট্রনীতি ও সরকার ব্যবস্থাপনায় কোথাও গলদ রয়েছে। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, দণি কোরিয়া, তাইওয়ান, ভিয়েতনাম যদি সার্বিকভাবে উন্নতি করতে পারে তাহলে বাংলাদেশ পারে না কেন? এ ব্যাপারে ভাবার সময় এসে গেছে। আর দেরি করলে আমরা অন্ধকারে ডুবে যাব। এ কথা সত্যি, ইংরেজরা আমাদের ১৯০ বছর শোষণ করেছে। এ দেশের সম্পদ লুণ্ঠন করে লন্ডন নিয়ে গেছে। উইলিয়াম হান্টারের বই পড়লেই বুঝতে পারবেন এ দেশের সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে মুসলমানেরা কিভাবে শোষিত হয়েছে। এরপর পাকিস্তানের ২৩ বছরেও এ দেশের মানুষ শোষিত হয়েছে। বাংলাদেশের ৪০ বছরেও সাধারণ মানুষ সীমাহীনভাবে শোষিত হয়েছে। পুঁজির বিকাশের নামে একশ্রেণীর লোককে রাতারাতি নোংরা ধনীতে পরিণত করা হয়েছে। ১৯৮২ সালে ব্যাংক করার সময় মাত্র তিন কোটি টাকা জোগাড় করতে ২৫-২৬ জন উদ্যোক্তাকে জড়ো করতে হয়েছে। এর ভেতরেও কয়েকজন ভুয়া চেক দিয়ে ডিরেক্টর হয়েছে। তখন প্রশ্ন উঠেছিল আয়কর নিয়ে। সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে বলা হলো, যদি আয়করের বিষয় জানতে চাওয়া হয় তাহলে ব্যাংক হবে না। আয়করের বিষয়টা পরে দেখা যাবে। এভাবেই প্রথম প্রজন্মের ব্যাংকগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এখন এক হাজার কোটি মূলধন দিয়ে একা ব্যাংক করতে চান অনেকেই। চলতি সরকারও রাজনৈতিক কারণে কয়েকটি ব্যাংকের অনুমতি দিয়েছে। সমাজের সুবিধাভোগীদের সরকার নানাভাবে সহযোগিতা করে থাকেন। গরিব মানুষের জমি দখল করে কম দামে সুবিধাভোগীদের মাঝে বিতরণ করা। যে জমির দাম খোলাবাজারে এক কোটি টাকা তা সরকার বিক্রি করেন পাঁচ লাখ টাকায়। এর মানে নিজেদের লোককে রাতারাতি কোটিপতি বানিয়ে দেয়া।
১৯৭০ সালে যে শ্রমিকের মজুরি ছিল দৈনিক দুই টাকা তার মজুরি এখন ৩০০-৪০০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ওই একই যে মানুষটার মাসিক বেতন ৩০০-৪০০ টাকা ছিল এখন তার সম্পদের পরিমাণ পাঁচ হাজার কোটি। ব্যাংকের কেরানি হয়েছে ব্যাংকের চেয়ারম্যান। অবাঙালি ২২ পরিবারের পোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে আমরা দেশ স্বাধীন করেছি। এখন ২২ হাজার পরিবার আমাদের শোষণ করছে। এ শোষণের সাথে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোও জড়িত। বঙ্গবন্ধু সমাজতন্ত্র কায়েম করবেন বলেই ছোট ব্যবসায় থেকে বড় বড় শিল্পকারখানা জাতীয়করণ করেছিলেন। বেসরকারি খাতে পুঁজি বিনিয়োগকে তিনি নিরুৎসাহিত করেছেন। কিন্তু তিনি তা করতে পারেননি। তার সময়েই দুর্বল খাদ্য ব্যবস্থাপনার কারণে দেশে দুর্ভি হয়েছিল। দুঃখ করে তিনি বলেছিলেন, সবাই পায় সোনার খনি আর আমি পেয়েছি চোরের খনি। তার আমলেই সর্বোচ্চ পুঁজি বিনিয়োগের সীমা ছিল ১০ লাখ টাকা। দুই বছরের মাথায় সেই সীমা বাড়িয়ে তিন কোটি টাকা করতে হয়েছিল। রাষ্ট্রায়ত্ত সব কলকারখানায় সীমাহীন লুটপাট করেই একশ্রেণীর মানুষ পুঁজিপতি হয়েছিল। এসব পুঁজিপতির মূলধন এসেছিল লুটপাট থেকে। ’৭১ সালের ১৬ থেকে ১৮ ডিসেম্বর যারা বাংলাদেশ ব্যাংকের (সে সময়ের স্টেট ব্যাংক) টাকা লুট করেছিল তারাও আজ বিরাট শিল্পপতি এবং জাতিকে কিভাবে দেশের উন্নতি করতে হবে সে ব্যাপারে সবক দেয়। আমি ধন বা পুঁজি সৃষ্টির বিরুদ্ধে নই। কিন্তু রাষ্ট্র বা গরিব মানুষকে শোষণ করে নোংরা সম্পদের পাহাড় গড়ে তা কোনো সমাজব্যবস্থা চাইতে পারে না। বাংলাদেশের পুঁজিপতিরা এখন কাউকেই তোয়াক্কা করে না। কোথাও কোনো বাধা দেখলে বা এলে তাকে শক্তি দিয়ে প্রতিহত করে অথবা টাকা দিয়ে বশে আনে। সব ধনীর সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর সখ্য আছে। মতায় যে দলই আসুক তাতে তাদের কোনো অসুবিধা হয় না। ফলে রাষ্ট্র ধনীদের দাসে পরিণত হয়। একদিকে অভ্যন্তরীণ ধনীদের চাপ, অন্য দিকে বাইরের মতাবান রাষ্ট্রের চাপ। এই তো দেখুন এক সপ্তাহের মধ্যেই জাপন, ভারত ও আমেরিকার নেতারা বাংলাদেশ সফর করে গেলেন। সবাই বলছে, আমরা কিছু নিতে আসিনি, দিতে এসেছি। হিলারি তো প্রায় সবার সাথেই দেখা করেছেন। এমন গরিব দেশে বড় বড় মেহমানের আগমন সাধারণ মানুষের মনে নানারকম প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে।
পৃথিবীর শক্তিধর দেশ বলে বহুল পরিচিত আমেরিকাতেও মানুষ ফুটপাথে থাকে। তাদের কোনো কাজ নেই। তারা হোমলেস বলে পরিচিত। এ রকম লোক আছে কয়েক লাখ। সেই আমেরিকা বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাস আর যুদ্ধ করে বেড়াচ্ছে। কিন্তু কেন? শুধু আমেরিকার মতাবানদের রা করার জন্য। ওই দেশের কিছু কাগজ ও মিডিয়া আছে যারা প্রতি বছরই ধনীদের তালিকা করে। এসব তালিকায় বিল গেটসের মতো ভালো মানুষের নামও আছে। চলতি বছর বিল ধনীর তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে নেমে এসেছেন। প্রথম স্থানে আছেন মেক্সিকোর এক ভদ্রলোকের নাম। কিন্তু ওই মিডিয়াকে যদি বলা হয়, পৃথিবীর দরিদ্রতম মানুষটির নাম বলুন, তারা কি তা পারবেন? না পারবেন না। কারণ দরিদ্রতম মানুষ তো একজন বা একশ’ জন নন। কয়েক শ’ কোটি লোক দরিদ্রতম। এমনকি পৃথিবীতে দরিদ্রতম দেশের তালিকাও প্রকাশ করা হয়। যার মধ্যে আমাদের প্রিয়তম দেশটিও আছে। এক সময় আমাদের এই দেশটি সুজলা সুফলা ছিল। বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশ ছিল। সারা বিশ্বের সওদাগরেরা এ দেশে এসেছে ব্যবসায় করার জন্য। শেষ পর্যন্ত ইংরেজরা ব্যবসায়ের নাম করে এ দেশটি দখল করে নেয় এবং ১৯০ বছর ধরে লুণ্ঠন করে। অখণ্ড বাংলার লুণ্ঠিত সম্পদ দিয়ে লন্ডনকে গড়ে তোলে। বাংলার সম্পদ নিয়ে বিভিন্ন দেশে কলোনি গড়ে তোলে। নানা রঙ ও নানারূপে বিদেশীরা আবার আমাদের দেশে আসছে।
আমেরিকা যুদ্ধবাজ হিসেবে এখনো পৃথিবীর এক নম্বর দেশ। কিন্তু তার আর্থিক অবস্থা পতনের দিকে। শুনেছি শুধু চীনের কাছেই তার তিন ট্রিলিয়ন ডলার দেনা রয়েছে। এক সময় চীন আর আমেরিকার সম্পর্ক ছিল সাপে-নেউলে। বেশি দিন আগের কথা নয়, যখন চীন নিষিদ্ধ ছিল আমেরিকানদের জন্য। বেইজিং রেডিও ও চীনের মিডিয়া আমেরিকাকে বলত কাগুজে বাঘ। আজ চীনের মাল না হলে আমেরিকার চলে না। চীনের মতো দেশেও এখনো কোটি লোক দরিদ্র রয়ে গেছে। চীন নিজেও এটা স্বীকার করে। এই চীনকেও এখন অস্ত্র প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে। কারণ আমেরিকা চীনের জন্য একটি নিশ্চিত হুমকি। আমেরিকা চীনের বিরুদ্ধে তাইওয়ান, জাপান, ভারত, দণি কোরিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে ব্যবহার করতে চায়। ভারত রাশিয়ার সাথে বন্ধুত্বকে শীতল করে আমেরিকাকে বুকে টেনে নিচ্ছে। ভারতেও কোটি লোক প্রতিদিন খেতে পায় না। সে দেশ চীনের সাথে অস্ত্র প্রতিযোগিতায় নেমেছে। ভারতও পরিচালিত হয় নোংরা ধনের ইশারায়। রাজনীতি ও রাষ্ট্রকে ভারতের ধনীরা দাসে পরিণত করেছে। সেখানে ৩০ কোটি হরিজনকে (ভগবানের সন্তান) মানুষ হিসেবে গণ্য করা হয় না। ভারতের সোয়া শ’ কোটি লোকের ভেতর এক শ’ কোটি লোক দরিদ্র। বাকি ৯০ শতাংশ মধ্যবিত্ত। আর বাকিরা ধনী এবং তাদের ুৎপিপাসু। এমনিতরো ভারত প্রতিবেশী সব দেশকে ভীতসন্ত্রস্ত করে রেখেছে। শ্রীলঙ্কার মতো শান্তশিষ্ট দেশকেও ভারত অশান্ত করে রেখেছে। পাকিস্তানকে তো জন্মের পর থেকেই ভয়ভীতি দেখিয়ে চাপে রেখেছে। ভারতের ভয়কে মোকাবেলা করার জন্যই পাকিস্তান আণবিক বোমা তৈরি করতে বাধ্য হয়েছে। অথচ দরিদ্র দেশ দু’টির কোটি কোটি দরিদ্র মানুষকে মানবিক জীবনদান করার জন্য রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী ও ধনীরা কিছুই করেননি। ভারত ইতোমধ্যেই অস্ত্র কেনা বা আমদানির ব্যাপারে প্রথম স্থান দখল করেছে।
ইউরোপের অবস্থা দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। সুপ্রাচীন মহাশক্তিধর দেশ গ্রিস দেউলিয়া হয়ে গেছে। কিন্তু সে দেশে বহু ধনী আছেন এখনো যাদের বিত্তের কোনো অভাব নেই। আইসল্যান্ড দেশটিও বিক্রি হওয়ার পথে। কেন এ রকম হচ্ছে তা ভাবার জন্য অর্থনীতিবিদ, রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীদের সময় এসে গেছে। আমার তো মনে হচ্ছে বিশ্বনীতি রিফর্ম বা সংস্কার করার সময় এসে গেছে। প্রমাণিত হয়ে গেছে, দেশের বেশির ভাগ মানুষকে ভুখা রেখে পুঁজির বিকাশ বা শুধু যুদ্ধ করলে কোনো দেশ টিকবে না। আমরা এক বিশ্বের স্লোগান দেবো আর মানুষ হয়ে মানুষকে শোষণ করব এমন নীতি ভণ্ডামি ছাড়া আর কিছুই নয়। আমেরিকা আর ইউরোপের নেতারা মানবকল্যাণের স্লোগান দেয়, জাতিসঙ্ঘ তাদের সাথে সুর মিলিয়ে কথা বলে, পুঁজিপতিরা সরকারকে ব্ল্যাকমেইল করে, কথায় কথায় বিনা কারণে ভিনদেশকে আক্রমণের হুমকি দেয়। অথচ নিজ দেশের কোটি কোটি ভুখা ও বসতিহীন মানুষের কথা মনে রাখে না। এই নেতারাই গরিব মানুষকে খাদ্য না দিয়ে উদ্বৃত্ত খাদ্য সাগরে ফেলে দেয়। মানুষকে ভুখা রেখে খাদ্য সাগরে ফেলে দেয়া দানবীয় শক্তিরই কাজ। প্রখ্যাত দার্শনিক কার্ল মার্কস দরিদ্র মানুষের মুক্তির জন্য যে কথা বলেছিলেন তা কমিউনিস্ট নেতারা বাস্তবায়ন করতে পারেননি। নেতারা নিজেরাই বিলাসবহুল জীবনযাপন করতেন নিরাপত্তার নামে। সব সম্পদের মালিক রাষ্ট্র , এই স্লোগান দিয়ে সম্পদ সৃষ্টির ব্যাপারে মানুষের জন্মগত আকাক্সাকে পীড়ন করা হয়েছে। ওই চিন্তা ছিল মানুষের প্রকৃতিগত প্রজ্ঞা ও মেধার বিরুদ্ধে। মানুষকে চিরকালের জন্য বাধ্য করা যায় না। গণচীন সঠিক সময়ে নিজেদের গতিপথ পরিবর্তন করেছে। তাই চীন আজ এক শক্তিশালী অর্থনৈতিক শক্তি। আমেরিকার সাথে অস্ত্রের প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে রাশিয়া মানুষের মৌলিক অধিকারের কথা ভুলে গিয়েছিল।
বাজেট নিয়ে লিখতে গিয়ে গত সপ্তাহে আমি বাংলাদেশের উন্নয়ন দর্শন নিয়ে কিছু কথা বলেছি। আমাদের অর্থনীতি যেভাবে চলছে তাতে গরিব হতদরিদ্র মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকবে। কাগজে-কলমে গরিবের পে কথা বলা আমরা শুনতে পাচ্ছি গত এক শ’ বছর ধরে। রাজনীতি আর ভাঁওতাবাজির জন্য কথাগুলো ঠিক আছে। যদি পাঁচ বছর সংসদ সদস্য থাকলে একটি লোক ধনী হতে পারে তাহলে গরিব মানুষগুলোর ভাগ্য এক শ’ বছরেও পরিবর্তন হচ্ছে না কেন। যদি ব্যবসায়ীরা বছরে ২০-৩০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেয় রাষ্ট্রকে হাত করে সেখানে গরিবের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে কোন পথে। রাষ্ট্র, সরকার, সংসদ, বুদ্ধিজীবী ও শিতি মানুষের মগজ ধোলাই করার সময় এসে গেছে। তা না হলে ১৬ কোটি মানুষের ভেতর ১৪ কোটিকে দরিদ্র রেখে দেশের উন্নতি কখনোই হবে না। একইভাবে বিশ্বের সাত শ’ কোটি মানুষের মধ্যে ছয় শ’ কোটি মানুষকে অভুক্ত বা অধিকারহারা রেখে এ বিশ্বের মুক্তি হবে না। তাই আমি বলছি বিশ্বের ছয় শ’ কোটি মানুষই একাট্টা হয়ে একজন দরিদ্রতম ব্যক্তি যার বা যাদের সম্পদ রাষ্ট্র এবং ধনীরা জোর করে নিয়ে নিজেরা ভোগ করছে আর সন্ত্রাসী কায়দায় দরিদ্রদের সন্ত্রস্ত করে রেখেছে।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক
ershadmz40@yahoo.com
পৃথিবীর দারিদ্রতম মানুষটি কে এ বিষয়ে আমার কোনো চিন্তাভাবনা কখনোই ছিল না। আমার মুরব্বি বিশিষ্ট ব্যাংকার মুজিবুল হায়দার চৌধুরী চিন্তাটি আমার মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু এ ব্যাপারে কোথাও কোনো তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায়নি। দারিদ্র্য নিয়ে আমাদের রাজনীতিক, অর্থনীতিক, দার্শনিক আর চিন্তকদের চিন্তার আর গবেষণার শেষ নেই। দরিদ্র কাকে বলে, দারিদ্র্য কত প্রকার, কী হলে একজন মানুষকে দরিদ্র বলা যাবে এসব কথা বলা হয়ে গেছে। শত শত বই লেখা হয়ে গেছে। ধনী দেশগুলো নানাভাবে দরিদ্র দেশগুলোকে ঋণ দিচ্ছে, সাহায্য দিচ্ছে। কিন্তু পৃথিবীর দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কমছে না। ৭০০ কোটি মানুষের এ পৃথিবীতে ৫০০ কোটি মানুষ দরিদ্র বা হতদরিদ্র। বিশ্বব্যাংকের বদৌলতে আমরা ইতোমধ্যে বহু নতুন শব্দ জানতে ও শিখতে পেরেছি। লেখক, সাংবাদিক, গবেষক, বুদ্ধিজীবীরা নিয়মিত বা হরহামেশা এসব শব্দ ব্যবহার করছেন। গত ৬৩ বছর ধরে আমরা দারিদ্র্যের কথা শুনে আসছি। দারিদ্র্য কমানোর জন্য কোথাও কারো কোনো চেষ্টার ত্রুটি নেই। কিন্তু দারিদ্র্য কমে না। এর রহস্য কী, কে বলতে পারবে? আমাদের প্রিয় পৃথিবীটা কি তাহলে একদিন এমন বিশাল দারিদ্র্য নিয়েই বিলীন হয়ে যাবে? আমার তো মনে হয় না এ জীবনে দারিদ্র্যমুক্ত একটি পৃথিবী দেখে যেতে পারব।
পৃথিবীতে এখনো যে সম্পদ আছে তার পূর্ণাঙ্গ ব্যবহার হয়নি। যেটুকু সম্পদ ব্যবহার হচ্ছে তার ৯৯ শতাংশেই চলে যাচ্ছে ধনী ও মতাবানদের কাছে। মতাবান আর ধনী দেশগুলো এ জনসম্পদ দিয়ে কী করছে? বেশির ভাগ উদ্বৃত্ত সম্পদ ব্যবহার হচ্ছে যুদ্ধে, সাধারণ মানুষকে হত্যা করার জন্য। সম্প্রতি ইউরোপ ও আমেরিকায় অকুপাই আন্দোলন হয়েছে। এ আন্দোলনে বহু মানুষ আহত ও নিহত হয়েছে। অকুপাই আন্দোলনের নেতাদের দাবি ছিল পৃথিবীর ৯৯ শতাংশ সম্পদের মালিকানা চলে গেছে এক ভাগ মানুষের কাছে। সেই এক ভাগ মানুষই পৃথিবীটাকে চালাচ্ছে। জগৎব্যাপী অশান্তি সৃষ্টি করে রেখেছে। তারাই জাতিসঙ্ঘকে নিয়ন্ত্রণ করে। জাতিসঙ্ঘ তাদেরই কথামতো চলে। জাতিসঙ্ঘই যুদ্ধের অনুমতি দেয়। আফগানিস্তানে যুদ্ধ চলছে অনেক বছর ধরে। এ যুদ্ধের কারণ কী, কেন এ যুদ্ধ চলছে কেউ বলতে পারে না। যুদ্ধের ফলাফল কী হবে তা আমরা সবাই জানি। ওবামা প্রশাসন এখন তালেবানদের সাথে আলোচনা শুরু করেছে। এই তো ৩০-৪০ বছর আগেও পৃথিবীর অবস্থা এমন ছিল না। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আমেরিকা এবং তার দোসররা এমন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে, যখন খুশি যেখানে সেখানে যুদ্ধ বাধিয়ে দিচ্ছে। এক সময় আমেরিকা এবং তার মিত্ররা কমিউনিজমকে ধ্বংস বা প্রতিহত করার জন্য লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে। তখন ইসলাম বা বেকুব মুসলমানেরা ছিল তাদের বন্ধু। কমিউনিজম দমনের জন্য মুসলমানেরা অন্ধের মতো পশ্চিমাদের সমর্থন করেছে। আজ সেই পশ্চিমারাই সন্ত্রাস দমনের নামে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। তাদের এই যুদ্ধে বাংলাদেশের সরকারগুলোও সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের একশ্রেণীর বামপন্থী আর বুদ্ধিজীবীরা আমেরিকার এই ভাঁওতাবাজিকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। সন্ত্রাস দমনের নামে ইসলামকে ধ্বংস করার এ উদ্যোগকে সমর্থন করার জন্য বিভিন্ন দেশকে আমেরিকা অর্থসাহায্য দিচ্ছে।
ক’দিন আগে নোবেল বিজয়ী জার্মান কবি গুন্টার গ্রাস একটি কবিতা লিখে পৃথিবীকে কাঁপিয়ে দিয়েছেন। মনের যাতনায় জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তিনি এই কবিতা লিখেছেন। সারা বিশ্বের বিখ্যাত কাগজগুলো তার ওই কবিতার অনুবাদ প্রকাশ করে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। আমিও উদ্বুদ্ধ হয়ে তার সেই কবিতা অনুবাদ করেছি। এই মহান কবি বলেছেন, সত্য কথা না বলে এতদিন চুপ থাকার জন্য তিনি এখন অনুতপ্ত। তিনি নিজেকে অপরাধী সাব্যস্ত করে নিন্দা করেছেন। গ্রাস তার কবিতায় যে সত্য কথাটি তুলে ধরেছেন তা হলো, ইসরাইলের কাছে আণবিক বোমা আছে, কিন্তু তা নিয়ে শক্তিধরেরা কোনো উচ্চবাচ্য করছে না। ইরান আণবিক বোমা তৈরি করছে এই সন্দেহে ইরানের বিরুদ্ধে নানা রকম ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। গ্রাস এ ব্যাপারে নিজের দেশ জার্মানিরও সমালোচনা করেছেন। বিশ্বের চলমান অশান্তির জন্য গ্রাস শক্তিধর দেশগুলোকে দায়ী করেছেন। মতার লড়াই ও অন্যকে নিজের প্রভাবে রাখা হাজার বছর আগেও ছিল। বিশ্ব জয় করে সেকান্দর বাদশাহ বা আলেক্সান্ডার ‘গ্রেট’ টাইটেল পেয়েছিলেন। একসময় বলা হতো বীরভোগ্যা বসুন্ধরা। বা জোর যার মুল্লুক তার। সেসব যুগ বা শতাব্দী পেরিয়ে মানুষ নাকি সভ্য হয়েছে। বিশ্বসভ্য হয়েছে এ ধারণাটা একেবারেই মিথ্যা। পুরো বিশ্বটাকে নিজেদের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য আমেরিকা তার পদলেহী দোসরেরা ভয়ভীতি দেখিয়ে দমন করে রেখেছে। আপনারা নিজেরাই দেখছেন, বাংলাদেশ গরিব ও দুর্বল হওয়ার কারণে শক্তিশালী দেশগুলো কী ধরনে ব্যবহার করছে। সত্যি কথা বলতে কী চলমান বিশ্বের অবস্থা দেখে আমার হয় না আমরা সভ্যজগতে বাস করছে।
শত চেষ্টা করেও আমরা গত ৬৩ বছরে আমরা দেশের মানুষকে দারিদ্র্যের ভয়াল অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে পারেননি। কারণ আমাদের রাজনীতিক ও আমলারা সাধারণ মানুষের উন্নতির দর্শনে বিশ্বাস করেন না। কৃষক শ্রমিকদের নিয়ে রাজনীতি আমাদের দেশে খুবই জনপ্রিয়। এতে অতি অল্প সময়ে রাজনীতিকেরা জনপ্রিয় হতে পারেন। আমার রাজনীতিক বন্ধুরা বলে, তুমি আসলে কি তা রাজনীতিতে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। জনগণ তোমার সম্পর্কে কী ভাবছে বা তোমাকে কিভাবে দেখছে সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ধরে নাও, তুমি দরবেশ নও, তবুও লোকে তোমাকে দরবেশ মনে করে। রাজনীতিতে এটা একধরনের ধোঁকাবাজি। মানে বাইরের খোলসটাই আসল। বাংলাদেশে ১৬ কোটি মানুষ, সব দল মিলে রাজনীতির সাথে সরাসরি জড়িত মাত্র কয়েক লাখ মানুষ। বাকি সব মানুষ ভোটার। কেউ নৌকা আর কেউ ধানের শীষ। কেউ জিয়া আর কেউ শেখ মুজিব। দেশের মানুষকে দারিদ্র্যমুক্ত করতে এত সময় লাগার কথা নয়। কিন্তু দারিদ্র্য আমাদের ছেড়ে যাচ্ছে না। এর মানে আমাদের রাষ্ট্রনীতি ও সরকার ব্যবস্থাপনায় কোথাও গলদ রয়েছে। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, দণি কোরিয়া, তাইওয়ান, ভিয়েতনাম যদি সার্বিকভাবে উন্নতি করতে পারে তাহলে বাংলাদেশ পারে না কেন? এ ব্যাপারে ভাবার সময় এসে গেছে। আর দেরি করলে আমরা অন্ধকারে ডুবে যাব। এ কথা সত্যি, ইংরেজরা আমাদের ১৯০ বছর শোষণ করেছে। এ দেশের সম্পদ লুণ্ঠন করে লন্ডন নিয়ে গেছে। উইলিয়াম হান্টারের বই পড়লেই বুঝতে পারবেন এ দেশের সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে মুসলমানেরা কিভাবে শোষিত হয়েছে। এরপর পাকিস্তানের ২৩ বছরেও এ দেশের মানুষ শোষিত হয়েছে। বাংলাদেশের ৪০ বছরেও সাধারণ মানুষ সীমাহীনভাবে শোষিত হয়েছে। পুঁজির বিকাশের নামে একশ্রেণীর লোককে রাতারাতি নোংরা ধনীতে পরিণত করা হয়েছে। ১৯৮২ সালে ব্যাংক করার সময় মাত্র তিন কোটি টাকা জোগাড় করতে ২৫-২৬ জন উদ্যোক্তাকে জড়ো করতে হয়েছে। এর ভেতরেও কয়েকজন ভুয়া চেক দিয়ে ডিরেক্টর হয়েছে। তখন প্রশ্ন উঠেছিল আয়কর নিয়ে। সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে বলা হলো, যদি আয়করের বিষয় জানতে চাওয়া হয় তাহলে ব্যাংক হবে না। আয়করের বিষয়টা পরে দেখা যাবে। এভাবেই প্রথম প্রজন্মের ব্যাংকগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এখন এক হাজার কোটি মূলধন দিয়ে একা ব্যাংক করতে চান অনেকেই। চলতি সরকারও রাজনৈতিক কারণে কয়েকটি ব্যাংকের অনুমতি দিয়েছে। সমাজের সুবিধাভোগীদের সরকার নানাভাবে সহযোগিতা করে থাকেন। গরিব মানুষের জমি দখল করে কম দামে সুবিধাভোগীদের মাঝে বিতরণ করা। যে জমির দাম খোলাবাজারে এক কোটি টাকা তা সরকার বিক্রি করেন পাঁচ লাখ টাকায়। এর মানে নিজেদের লোককে রাতারাতি কোটিপতি বানিয়ে দেয়া।
১৯৭০ সালে যে শ্রমিকের মজুরি ছিল দৈনিক দুই টাকা তার মজুরি এখন ৩০০-৪০০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ওই একই যে মানুষটার মাসিক বেতন ৩০০-৪০০ টাকা ছিল এখন তার সম্পদের পরিমাণ পাঁচ হাজার কোটি। ব্যাংকের কেরানি হয়েছে ব্যাংকের চেয়ারম্যান। অবাঙালি ২২ পরিবারের পোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে আমরা দেশ স্বাধীন করেছি। এখন ২২ হাজার পরিবার আমাদের শোষণ করছে। এ শোষণের সাথে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোও জড়িত। বঙ্গবন্ধু সমাজতন্ত্র কায়েম করবেন বলেই ছোট ব্যবসায় থেকে বড় বড় শিল্পকারখানা জাতীয়করণ করেছিলেন। বেসরকারি খাতে পুঁজি বিনিয়োগকে তিনি নিরুৎসাহিত করেছেন। কিন্তু তিনি তা করতে পারেননি। তার সময়েই দুর্বল খাদ্য ব্যবস্থাপনার কারণে দেশে দুর্ভি হয়েছিল। দুঃখ করে তিনি বলেছিলেন, সবাই পায় সোনার খনি আর আমি পেয়েছি চোরের খনি। তার আমলেই সর্বোচ্চ পুঁজি বিনিয়োগের সীমা ছিল ১০ লাখ টাকা। দুই বছরের মাথায় সেই সীমা বাড়িয়ে তিন কোটি টাকা করতে হয়েছিল। রাষ্ট্রায়ত্ত সব কলকারখানায় সীমাহীন লুটপাট করেই একশ্রেণীর মানুষ পুঁজিপতি হয়েছিল। এসব পুঁজিপতির মূলধন এসেছিল লুটপাট থেকে। ’৭১ সালের ১৬ থেকে ১৮ ডিসেম্বর যারা বাংলাদেশ ব্যাংকের (সে সময়ের স্টেট ব্যাংক) টাকা লুট করেছিল তারাও আজ বিরাট শিল্পপতি এবং জাতিকে কিভাবে দেশের উন্নতি করতে হবে সে ব্যাপারে সবক দেয়। আমি ধন বা পুঁজি সৃষ্টির বিরুদ্ধে নই। কিন্তু রাষ্ট্র বা গরিব মানুষকে শোষণ করে নোংরা সম্পদের পাহাড় গড়ে তা কোনো সমাজব্যবস্থা চাইতে পারে না। বাংলাদেশের পুঁজিপতিরা এখন কাউকেই তোয়াক্কা করে না। কোথাও কোনো বাধা দেখলে বা এলে তাকে শক্তি দিয়ে প্রতিহত করে অথবা টাকা দিয়ে বশে আনে। সব ধনীর সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর সখ্য আছে। মতায় যে দলই আসুক তাতে তাদের কোনো অসুবিধা হয় না। ফলে রাষ্ট্র ধনীদের দাসে পরিণত হয়। একদিকে অভ্যন্তরীণ ধনীদের চাপ, অন্য দিকে বাইরের মতাবান রাষ্ট্রের চাপ। এই তো দেখুন এক সপ্তাহের মধ্যেই জাপন, ভারত ও আমেরিকার নেতারা বাংলাদেশ সফর করে গেলেন। সবাই বলছে, আমরা কিছু নিতে আসিনি, দিতে এসেছি। হিলারি তো প্রায় সবার সাথেই দেখা করেছেন। এমন গরিব দেশে বড় বড় মেহমানের আগমন সাধারণ মানুষের মনে নানারকম প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে।
পৃথিবীর শক্তিধর দেশ বলে বহুল পরিচিত আমেরিকাতেও মানুষ ফুটপাথে থাকে। তাদের কোনো কাজ নেই। তারা হোমলেস বলে পরিচিত। এ রকম লোক আছে কয়েক লাখ। সেই আমেরিকা বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাস আর যুদ্ধ করে বেড়াচ্ছে। কিন্তু কেন? শুধু আমেরিকার মতাবানদের রা করার জন্য। ওই দেশের কিছু কাগজ ও মিডিয়া আছে যারা প্রতি বছরই ধনীদের তালিকা করে। এসব তালিকায় বিল গেটসের মতো ভালো মানুষের নামও আছে। চলতি বছর বিল ধনীর তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে নেমে এসেছেন। প্রথম স্থানে আছেন মেক্সিকোর এক ভদ্রলোকের নাম। কিন্তু ওই মিডিয়াকে যদি বলা হয়, পৃথিবীর দরিদ্রতম মানুষটির নাম বলুন, তারা কি তা পারবেন? না পারবেন না। কারণ দরিদ্রতম মানুষ তো একজন বা একশ’ জন নন। কয়েক শ’ কোটি লোক দরিদ্রতম। এমনকি পৃথিবীতে দরিদ্রতম দেশের তালিকাও প্রকাশ করা হয়। যার মধ্যে আমাদের প্রিয়তম দেশটিও আছে। এক সময় আমাদের এই দেশটি সুজলা সুফলা ছিল। বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশ ছিল। সারা বিশ্বের সওদাগরেরা এ দেশে এসেছে ব্যবসায় করার জন্য। শেষ পর্যন্ত ইংরেজরা ব্যবসায়ের নাম করে এ দেশটি দখল করে নেয় এবং ১৯০ বছর ধরে লুণ্ঠন করে। অখণ্ড বাংলার লুণ্ঠিত সম্পদ দিয়ে লন্ডনকে গড়ে তোলে। বাংলার সম্পদ নিয়ে বিভিন্ন দেশে কলোনি গড়ে তোলে। নানা রঙ ও নানারূপে বিদেশীরা আবার আমাদের দেশে আসছে।
আমেরিকা যুদ্ধবাজ হিসেবে এখনো পৃথিবীর এক নম্বর দেশ। কিন্তু তার আর্থিক অবস্থা পতনের দিকে। শুনেছি শুধু চীনের কাছেই তার তিন ট্রিলিয়ন ডলার দেনা রয়েছে। এক সময় চীন আর আমেরিকার সম্পর্ক ছিল সাপে-নেউলে। বেশি দিন আগের কথা নয়, যখন চীন নিষিদ্ধ ছিল আমেরিকানদের জন্য। বেইজিং রেডিও ও চীনের মিডিয়া আমেরিকাকে বলত কাগুজে বাঘ। আজ চীনের মাল না হলে আমেরিকার চলে না। চীনের মতো দেশেও এখনো কোটি লোক দরিদ্র রয়ে গেছে। চীন নিজেও এটা স্বীকার করে। এই চীনকেও এখন অস্ত্র প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে। কারণ আমেরিকা চীনের জন্য একটি নিশ্চিত হুমকি। আমেরিকা চীনের বিরুদ্ধে তাইওয়ান, জাপান, ভারত, দণি কোরিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে ব্যবহার করতে চায়। ভারত রাশিয়ার সাথে বন্ধুত্বকে শীতল করে আমেরিকাকে বুকে টেনে নিচ্ছে। ভারতেও কোটি লোক প্রতিদিন খেতে পায় না। সে দেশ চীনের সাথে অস্ত্র প্রতিযোগিতায় নেমেছে। ভারতও পরিচালিত হয় নোংরা ধনের ইশারায়। রাজনীতি ও রাষ্ট্রকে ভারতের ধনীরা দাসে পরিণত করেছে। সেখানে ৩০ কোটি হরিজনকে (ভগবানের সন্তান) মানুষ হিসেবে গণ্য করা হয় না। ভারতের সোয়া শ’ কোটি লোকের ভেতর এক শ’ কোটি লোক দরিদ্র। বাকি ৯০ শতাংশ মধ্যবিত্ত। আর বাকিরা ধনী এবং তাদের ুৎপিপাসু। এমনিতরো ভারত প্রতিবেশী সব দেশকে ভীতসন্ত্রস্ত করে রেখেছে। শ্রীলঙ্কার মতো শান্তশিষ্ট দেশকেও ভারত অশান্ত করে রেখেছে। পাকিস্তানকে তো জন্মের পর থেকেই ভয়ভীতি দেখিয়ে চাপে রেখেছে। ভারতের ভয়কে মোকাবেলা করার জন্যই পাকিস্তান আণবিক বোমা তৈরি করতে বাধ্য হয়েছে। অথচ দরিদ্র দেশ দু’টির কোটি কোটি দরিদ্র মানুষকে মানবিক জীবনদান করার জন্য রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী ও ধনীরা কিছুই করেননি। ভারত ইতোমধ্যেই অস্ত্র কেনা বা আমদানির ব্যাপারে প্রথম স্থান দখল করেছে।
ইউরোপের অবস্থা দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। সুপ্রাচীন মহাশক্তিধর দেশ গ্রিস দেউলিয়া হয়ে গেছে। কিন্তু সে দেশে বহু ধনী আছেন এখনো যাদের বিত্তের কোনো অভাব নেই। আইসল্যান্ড দেশটিও বিক্রি হওয়ার পথে। কেন এ রকম হচ্ছে তা ভাবার জন্য অর্থনীতিবিদ, রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীদের সময় এসে গেছে। আমার তো মনে হচ্ছে বিশ্বনীতি রিফর্ম বা সংস্কার করার সময় এসে গেছে। প্রমাণিত হয়ে গেছে, দেশের বেশির ভাগ মানুষকে ভুখা রেখে পুঁজির বিকাশ বা শুধু যুদ্ধ করলে কোনো দেশ টিকবে না। আমরা এক বিশ্বের স্লোগান দেবো আর মানুষ হয়ে মানুষকে শোষণ করব এমন নীতি ভণ্ডামি ছাড়া আর কিছুই নয়। আমেরিকা আর ইউরোপের নেতারা মানবকল্যাণের স্লোগান দেয়, জাতিসঙ্ঘ তাদের সাথে সুর মিলিয়ে কথা বলে, পুঁজিপতিরা সরকারকে ব্ল্যাকমেইল করে, কথায় কথায় বিনা কারণে ভিনদেশকে আক্রমণের হুমকি দেয়। অথচ নিজ দেশের কোটি কোটি ভুখা ও বসতিহীন মানুষের কথা মনে রাখে না। এই নেতারাই গরিব মানুষকে খাদ্য না দিয়ে উদ্বৃত্ত খাদ্য সাগরে ফেলে দেয়। মানুষকে ভুখা রেখে খাদ্য সাগরে ফেলে দেয়া দানবীয় শক্তিরই কাজ। প্রখ্যাত দার্শনিক কার্ল মার্কস দরিদ্র মানুষের মুক্তির জন্য যে কথা বলেছিলেন তা কমিউনিস্ট নেতারা বাস্তবায়ন করতে পারেননি। নেতারা নিজেরাই বিলাসবহুল জীবনযাপন করতেন নিরাপত্তার নামে। সব সম্পদের মালিক রাষ্ট্র , এই স্লোগান দিয়ে সম্পদ সৃষ্টির ব্যাপারে মানুষের জন্মগত আকাক্সাকে পীড়ন করা হয়েছে। ওই চিন্তা ছিল মানুষের প্রকৃতিগত প্রজ্ঞা ও মেধার বিরুদ্ধে। মানুষকে চিরকালের জন্য বাধ্য করা যায় না। গণচীন সঠিক সময়ে নিজেদের গতিপথ পরিবর্তন করেছে। তাই চীন আজ এক শক্তিশালী অর্থনৈতিক শক্তি। আমেরিকার সাথে অস্ত্রের প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে রাশিয়া মানুষের মৌলিক অধিকারের কথা ভুলে গিয়েছিল।
বাজেট নিয়ে লিখতে গিয়ে গত সপ্তাহে আমি বাংলাদেশের উন্নয়ন দর্শন নিয়ে কিছু কথা বলেছি। আমাদের অর্থনীতি যেভাবে চলছে তাতে গরিব হতদরিদ্র মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকবে। কাগজে-কলমে গরিবের পে কথা বলা আমরা শুনতে পাচ্ছি গত এক শ’ বছর ধরে। রাজনীতি আর ভাঁওতাবাজির জন্য কথাগুলো ঠিক আছে। যদি পাঁচ বছর সংসদ সদস্য থাকলে একটি লোক ধনী হতে পারে তাহলে গরিব মানুষগুলোর ভাগ্য এক শ’ বছরেও পরিবর্তন হচ্ছে না কেন। যদি ব্যবসায়ীরা বছরে ২০-৩০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেয় রাষ্ট্রকে হাত করে সেখানে গরিবের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে কোন পথে। রাষ্ট্র, সরকার, সংসদ, বুদ্ধিজীবী ও শিতি মানুষের মগজ ধোলাই করার সময় এসে গেছে। তা না হলে ১৬ কোটি মানুষের ভেতর ১৪ কোটিকে দরিদ্র রেখে দেশের উন্নতি কখনোই হবে না। একইভাবে বিশ্বের সাত শ’ কোটি মানুষের মধ্যে ছয় শ’ কোটি মানুষকে অভুক্ত বা অধিকারহারা রেখে এ বিশ্বের মুক্তি হবে না। তাই আমি বলছি বিশ্বের ছয় শ’ কোটি মানুষই একাট্টা হয়ে একজন দরিদ্রতম ব্যক্তি যার বা যাদের সম্পদ রাষ্ট্র এবং ধনীরা জোর করে নিয়ে নিজেরা ভোগ করছে আর সন্ত্রাসী কায়দায় দরিদ্রদের সন্ত্রস্ত করে রেখেছে।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক
ershadmz40@yahoo.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন