শনিবার, ৫ মে, ২০১২

বাজেট কেন এবং কাদের জন্য




॥ এরশাদ মজুমদার ॥

আমি অর্থনীতিবিদ নই। বাজেট প্রণয়নকারী বিশেষজ্ঞও নই। তবে সাংবাদিক হিসেবে দীর্ঘকাল ধরে বাজেট নিয়ে কাজ করেছি। এ ছাড়া দেশের উন্নয়নে আমার নিজস্ব একটি চিন্তা ও ধারণা আছে। আমাদের চলমান বাজেটব্যবস্থা কখনোই দেশের সব মানুষের এক শ’ ভাগ কল্যাণ বা উন্নয়ন সাধন করতে পারবে না। বাজেট রচনা বা প্রণয়নে যারা মাথা ঘামান বা রাতদিন পরিশ্রম করেন, তারা গতানুগতিকভাবেই তা তৈরি করেন। ব্রিটিশ বা পাকিস্তানি আমলের সাথে চলমান বাজেট তৈরির প্রক্রিয়ার কোনো বড় ফারাক নেই। একেবারেই সেকেলে ঘুণেধরা ব্যবস্থা। আমাদের বাজেট প্রণয়ন পদ্ধতি বা ব্যবস্থা না ধনতান্ত্রিক, না সমাজতান্ত্রিক, না ইসলামিক। একটা জগাখিচুড়ি। বর্তমান অর্থমন্ত্রী একজন সাবেক আমলা। তিরিশ বছর বা তারও বেশি সময় পাকিস্তান ও বাংলাদেশ সরকারের খেদমত করেছেন আমলা হিসেবে। পাকিস্তান বা ব্রিটিশ আমলে বহু বাঙালি মুসলমান রাজনীতিক ইচ্ছা করলে বড় আমলা হতে পারতেন। যেমন ধরুন, শেরেবাংলা, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, স্যার খাজা নাজিমুদ্দিন, মৌলবী তমিজউদ্দিন, নূরুল আমিন প্রমুখ। তারা সবাই মেধাবী ছিলেন। কিন্তু আমলা না হয়ে রাজনীতিতে এসেছেন দেশের সেবা করার জন্য।
তৎকালীন পূর্ববাংলা ও বর্তমান বাংলাদেশে জমিদারিব্যবস্থা উচ্ছেদ করা হয়েছে ১৯৫০ সালে মুসলিম লীগ আমলে। সরকারের এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন বড় বড় জমিদার বাবু, যারা সমাজে প্রগতিশীল বলে পরিচিত ছিলেন। জিন্নাহ সাহেব একবার বলেছিলেন, পাকিস্তানের প্রয়োজন পূর্ববঙ্গের গরিব মুসলমান কৃষকদের মুক্তির জন্য। এর মানে, পূর্ববঙ্গের মুসলমানেরা এত বেশি শোষিত হয়েছে যে, তাদের মুক্তির জন্য পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল। যদিও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ও পূর্ববঙ্গের মুসলিম লীগ নেতারা সে কথা ভুলে গিয়েছিলেন। জমিদারিব্যবস্থা বাতিল বা উচ্ছেদ করাটা ছিল একটি বিপ্লবী পদপে, যার প্রশংসা করেছিল রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি। পূর্ববঙ্গের বেশির ভাগ জমিদারই ছিলেন হিন্দু এবং তারা ছিলেন কলকাতার অধিবাসী। শুনেছি ১৯৫৭ সালে যুক্তফ্রন্ট, যার অন্যতম শরিক ছিল আওয়ামী লীগ, মতায় থাকাকালে জমিদার বাবুরা মুসলিম লীগের ওই বিপ্লবী পদেেপর বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন। এ কথা আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, যুক্তফ্রন্ট গঠনের সময় তাতে যোগ দিয়েছিল কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট পার্টি। জমিদার বাবুদের অনেকেই কংগ্রেস করতেন। মুসলিম লীগ যে এমন একটি বিপ্লবী কাজ করতে পারে, তা কংগ্রেসি জমিদার বাবুরা বিশ্বাস করতে পারেননি। এই মুসলিম লীগই মুসলমান প্রজাদের ঋণের বোঝা থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য ঋণ সালিশি বোর্ড গঠন করেছিল, যা শেরেবাংলা বাস্তবায়ন করেছিলেন। বিষয়টি উল্লেখ করলাম আমাদের নতুন প্রজন্মের জন্য। মুসলিম লীগের মতো একটি দণিপন্থী রাজনৈতিক দলও সাধারণ মানুষের মুক্তির জন্য এমন একটি প্রগতিশীল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিল। বাংলাদেশে এখন মুসলিম লীগ নেই বললেই চলে। তবে আমি নিজেও মনে করি, মুসলিম লীগ কখনোই গণমানুষের রাজনৈতিক দল ছিল না। যদিও মুসলিম লীগকে নির্যাতিত মুসলিম জনসাধারণ সমর্থন দিয়েছিল সময়ের চাহিদার কারণে।
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন রোজ গার্ডেনে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে মুসলিম লীগবিরোধী রাজনৈতিক দল আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়। মওলানা সাহেব বলতেন, আমরা হলাম জনগণের মুসলিম লীগ, আর শুধু মুসলিম লীগ হলো খাজাগজার দল। আওয়ামী মুসলিম লীগে যারা যোগ দিয়েছিলেন তারা সবাই ছিলেন সাধারণ মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের মানুষ। মুসলিম লীগ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করেছে এই দম্ভেই আত্মহারা ছিল। ফলে ’৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগেই দলটি জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। মওলানা ভাসানী শেরেবাংলা ও সোহরাওয়ার্দীকে নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন করলেন, যা মুসলিম লীগকে পূর্ববঙ্গের রাজনীতি থেকে বিদায় দেয়। তারপর মুসলিম লীগ এ দেশের রাজনীতিতে আর ফিরে আসতে পারেনি। রাজনীতি থেকে শেরওয়ানি, চোস্ত পাজামা আর জিন্নাহ টুপি বিদায় নিলো; এলো লুঙ্গি, শার্ট, পাজামা, পাঞ্জাবি। রাজনীতি উকিল-মোক্তার, জমিদার-জোতদার, তালুকদারদের চেম্বার ও কাচারিঘর থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল অতি মধ্যবিত্তের দুয়ারে। এখন রাজনীতি বাংলাদেশের ঘরে ঘরে। বাঙালিরা, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণী রাজনীতি না করে থাকতে পারে না। এখন রিকশাচলক, ফেরিওয়ালাও সংবিধানের কথা বলে। গ্রাম, আধা শহর ও পুরো শহরে মধ্যবিত্তরা চায়ের কাপে রাজনীতির ঝড় তোলে। দুই টাকার কাগজ না পড়লে তাদের ভাতই হজম হয় না।
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ৪০ বছর পার হয়ে গেছে। মধ্যবিত্তের রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ’৭২ সালে ব্যাংকের কেরানি বা কার্ক ছিলেন এমন ব্যক্তি এখন ব্যাংকের চেয়ারম্যান হয়েছেন। আমদানি অফিসের কেরানি এখন পাঁচ হাজার কোটি টাকার শিল্প গ্রুপের মালিক। ’৭২ সালে যেখানে এক কাঠা জমির দাম দুই হাজার টাকা ছিল, তা এখন দুই কোটি টাকা। রাজউক বা ডিআইটি যে জমি পাঁচ হাজার টাকায় বরাদ্দ দিয়েছিল তা এখন এক শ’ কোটি টাকা। সরকারি সহযোগিতা বা অনুকম্পা পেয়ে যারা সরকারি জমি পেয়েছেন তারা রাতারাতি ধনী হয়ে গেছেন। ’৮২ সালে একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করতে তিন কোটি টাকা লেগেছে উদ্যোক্তাদের। সেই তিন কোটি টাকা জোগাড় করতে ২৫-২৬ জন উদ্যোক্তার প্রয়োজন হয়েছে। এখন একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করতে চার শ’ কোটি টাকা লাগবে। অনুমতি পাওয়ার জন্য আরো চার-পাঁচ শ’ কোটি টাকা লাগে বলে শুনেছি। এমন উদ্যোক্তাও আছেন যিনি একাই এক হাজার কোটি টাকা দিয়ে ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করতে চান। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, রাজনৈতিক কারণে নতুন ব্যাংকের অনুমতি দেয়া হচ্ছে। যাদের ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়া হচ্ছে তারা তা বিক্রি করে হয়তো পাবেন এক শ’ কোটি টাকা। রাজউক এত দিন পর বলছে, এখন থেকে আর জমি বরাদ্দ দেয়া হবে না। এখন মধ্যবিত্তদের ফ্যাট বরাদ্দ দেয়া হবে। জানি না রাজউকের এ ওয়াদা কতটুকু সত্য হবে। রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের ভালোবাসার মানুষদের ধনী বানানোর এর চেয়ে সহজ পথ আর কোথায় পাবে।
রাজধানীর চার দিকে এখন নদী দখল চলছে। এই দখলি ব্যবসায় করছেন রাজনৈতিক আশ্রয়ে পরিপুষ্ট শক্তিধর ব্যক্তিরা। গরিব মানুষের জমি দখল করে রাজউক এবং ধনীরা প্লট বানিয়ে বিক্রি করছেন। আপনারা প্রতিদিন খবরের কাগজে ও টিভিতে জমি বিক্রির বিজ্ঞাপন দেখেন। নামমাত্র মূল্যে জমি দখল করে সেই জমি হাজার কোটি টাকায় বিক্রি হচ্ছে। রাজধানীর চার দিকে এখন শুধু হাউজিংয়ের বিজ্ঞাপন। পত্রিকাওয়ালারাও বেশ খুশি। যত বেশি রঙিন বিজ্ঞাপন তত বেশি টাকা। খুবই আনন্দের খবর। একটা সময় ছিল যখন পত্রিকার প্রথম পাতায় চব্বিশ ইঞ্চির বেশি বিজ্ঞাপন ছাপা হতো না। পাঠকের অধিকার বলেও তো একটি কথা আছে। এখন পাঠকদের সেই অধিকার নেই। সাংবাদিকেরা বলবেন, আমরা শ্রমিক মানুষ, ভালো বেতন পেলেই খুশি। পত্রিকা যদি বেশি বেশি বিজ্ঞাপন না পায়, তাহলে আমাদের অষ্টম ওয়েজবোর্ড দেবে কোত্থেকে। আগেই বলেছি, রাজনীতি এখন মধ্যবিত্তের দুয়ারে। ধনীরা রাজনৈতিক দলগুলোকে ভালোবেসে চুমা খায়। চাওয়া মাত্রই টাকা দেয়। সরকারে থাকলে মাসে পাঁচ শ’ কোটি, আর বিরোধী দলে থাকলে মাসে পঞ্চাশ কোটি। এবার আপনারাই বলুন, বেচারা রাজনৈতিক দলগুলো টাকার এই ভালোবাসাকে কিভাবে উপো করবে। গ্রামগঞ্জে, হাটবাজারে চাঁদাবাজির এই ব্যবস্থা ছড়িয়ে পড়েছে। মতাসীন দলের ইউনিয়ন নেতারও মাসে লাখখানেক টাকা চাঁদা আদায় হয়। যদি কখনো প্রশ্ন করেন, ভাই কেমন আছেন? ভাই উত্তরে বলবেন, বোঝেনই তো দল মতায় থাকলে যা হয়। সারা দিন ব্যস্ত থাকতে হয়। ব্যবসায়-বাণিজ্য কিছু করছেন নাকি? সময় কোথায় বলুন? তা হলে? দল চালাতে হলে তো কিছু চাঁদা নিতেই হয়। জনসাধারণ ভালোবেসেই মাসে মাসে কিছু টাকা দেয়। এ ছাড়া আমাদের ছেলেরাই তো উন্নয়নের কাজ করছে। টেন্ডারগুলো তারাই পায়। বুঝতেই তো পারেন রাজনীতি করতে হলে এসব তো করতে হবে।
রাজধানীর পর্যায়ে চাঁদাবাজির কথা আগেই বলেছি। এ ছাড়া রাজনীতিতে উপরি পাওনা তো আছেই। সুরঞ্জিত বাবুর গল্প তো আপনারা জানতেই পেরেছেন। ওনার ছেলেও ছয় মাস চাকরি করে পাঁচ কোটি টাকা জমা দিয়ে টেলি ব্যবসায় জোগাড় করেছেন। তিনি দুদকে জবানবন্দি দিয়ে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, বন্ধুরা তাকে টাকা দিয়েছেন। সুরঞ্জিত বাবুর ছেলের মতো এ দেশে আরো বহু ছেলে আছে, যাদের বন্ধুরা সরকারি ব্যবসা পাওয়ার জন্য এভাবে টাকা দেয় না। কারণ, তাদের বাবা মন্ত্রী নন। শুনেছি এ জামানায় সংসদ সদস্য হতে নির্বাচনে চার-পাঁচ কোটি টাকা খরচ করতে হয়। মন্ত্রিত্ব পেতেও নিশ্চয়ই টাকা খরচ করতে হয়। দল যদি নির্বাচন করতে হাজার কোটি টাকা খরচ করে, সে টাকা দলনেতা কোথায় পাবেন? বাধ্য হয়েই দলনেতাকে বড় বড় ব্যবসায়ীর কাছে ওয়াদা করতে হয়Ñ মতায় গেলে পুষিয়ে দেবো। পদ্মা সেতুর ঘটনাটা হয়তো তেমনি একটা কিছু। তাই ব্যবসায়ী আবুল সাহেবকে কিছু করা যায়নি। সুরঞ্জিত বাবুর ঘটনাটা একটু ভাবুন। তার ওজারতি গিয়েও যায়নি। তিনি এখন উজিরে খামাখা। এর মানে হলো দপ্তরবিহীন মন্ত্রী। উর্দুতে বলে উজিরে খামাখা। মানে কাজ নেই, নিয়মিত সরকারি তহবিল থেকে টাকা-পয়সা নিয়ে সংসার চালাবেন।
আমাদের দেশের দুর্নীতি সম্পর্কে টিআইবি (ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ) বহু দিন ধরে প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে। সে প্রতিবেদন আমাদের জন্য মর্যাদার কিছু নয়। এতে বিশ্ববাসীর কাছে আমাদের মাথা হেঁট হয়ে যায়। তবে দুর্নীতির বিষয়টি এখন আর কেউ গায়ে মাখে না। সরকারি অফিসের পিয়ন থেকে সচিব-মন্ত্রী পর্যন্ত সবাই পদমর্যাদার খাজনা, সেলামি বা সম্মানী আদায় করেন। ছেলেবেলায় চাপরাশিবাড়ির কথা শুনেছি। এটি একটি সরকারি চাকরি। চাপরাশির চাকরি করে ভদ্রলোক আয়-রোজগার করে সমাজে সম্মান অর্জন করেছিলেন। এমনকি সারা জীবন উমেদারের চাকরি করেও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করেছেন এমন লোক ছিল। উমেদার হচ্ছেন, যিনি চাকরির জন্য আবেদন করেছেন, এখনো পাননি। কিন্তু বিনাবেতনে বা বিনেপয়সায় কাজ করছেন বা শিখছেন। উমেদারকেও লোকে খুশি হয়ে দু-চার পয়সা হাতে গুঁজে দিত। এ তো গেল সরকারি অফিসের উপরি লেনদেনের কিসসা। আপনারা ইতোমধ্যেই জানতে পেরেছেন, আগামী বাজেটের সাইজ হবে এক লাখ আশি হাজার কোটি টাকা। সরকারি কর্মচারীরা যদি মাত্র দশ পার্সেন্ট করে উপরি গ্রহণ করেন, তাহলে তার পরিমাণ হবে বছরে ১৮ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশে উপরি আদায়ের পরিমাণ বা পার্সেন্টেজ আপনারা নিশ্চয়ই জানেন। আমি তো বলি, দশ পার্সেন্ট হাতখরচ জাতি দিতেই পারে। ছেলেবেলায় শুনেছি, যে বাজার করে সে পান বিড়ির জন্য দু-চার পয়সা রাখত। শুনেছি, করাচিতে বাসাবাড়ির বাঙালি কেয়ারটেকাররা শর্ত দিত, বাজার করার সুযোগ দিতে হবে। বড় বড় হোটেল বা রেস্টুরেন্টে টিপস দেয়া একটা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। কোনো হোটেলে টিপস বিলের সাথে যোগ করে দেয়া হয়। একসময় এই টিপসকে বখশিশ বলা হতো।
এতণ ধরে আপনাদের কাছে স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনীতির পারিপার্শ্বিক অবস্থার কথা বলেছি। আমার মূল আলোচনা হচ্ছে বাজেট নিয়ে। আমাদের সবার জীবনেই বাজেট আছে। যারা চাকরি করেন তারা বেতন এবং উপরি, বাড়তি বা ঘুষ নিয়ে মাসিক বাজেট করেন। বড় বড় ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, জমির ডেভেলপাররা সংসার খরচের জন্য তেমন বাজেট তৈরি করেন না। কারণ তাদের কাছে প্রচুর টাকা থাকে। সে টাকা ব্যাংকের বা ব্যবসায়ের। এ ব্যাপারে মরহুম সাইফুর রহমান সাহেব বলতেন, শিল্প বা ব্যবসায়ের অবস্থা খারাপ। কিন্তু মালিকের অবস্থা খুবই ভালো। তারা পাজেরো বা বিএমডব্লিউতে চড়েন। বড় বড় ভিলা বানান। কর্মচারীর বেতন ঠিক সময় দেন না। একইভাবে সরকারও বাজেট তৈরি করে রাজস্ব আদায়, বিদেশী ঋণ, দেশী ঋণের ওপর নির্ভর করে। ইদানীং বিদেশী ঋণের পরিমাণ অনেক কমে গেছে। পুরনো বিদেশী ঋণ অনেক বাকি পড়ে গেছে। নিয়মিত কিস্তি শোধ হচ্ছে না। চলতি সরকার মনের মাধুরী মিশিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সরকার চালাচ্ছে। ডিপোজিটের ওপর সুদের হার ঠিক নেই। জনসাধারণ সরকারি প্রতিষ্ঠানে এখন আর সঞ্চয় রাখতে চায় না। এক লাখ আশি হাজার কোটি টাকার বাজেটের মধ্যে সরকারের কর্মচারীর বেতন, রণাবেণ, পেনশনবাবদই খরচ হয় বেশির ভাগ টাকা। এর মানে হচ্ছেÑ এক শ’ টাকার ব্যবসায় চালাতে গিয়ে ম্যানেজারের বেতন দিতে হয় দেড় শ’ টাকা। তাহলেই বুঝতে পারেন, এ ব্যবসায় কত দিন চলবে। সরকারের সাইজও দিন দিন বেড়ে চলেছে। ১-১১-এর সরকারের দিকে একবার নজর দিন। সরকারের বেতনভুক কর্মচারীরাই সরকার দখল করে দুই বছর দেশবাসীকে হেনস্তা করেছেন। এখন তারা দেশত্যাগী হয়েছেন। যাওয়ার সময় গণতন্ত্রের জোব্বা পরিয়ে আওয়ামী লীগকে মতায় বসিয়ে দিয়ে গেছেন। মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীনের কাছ থেকে ২৪০ সিট নিয়ে আওয়ামী লীগ এখন মতায়। বলা যেতে পারে ১-১১-এর সরকারের বৈধ ওয়ারিশ হচ্ছে আওয়ামী লীগ। গণতন্ত্র আর দেশ রার জন্য এখন আওয়ামী লীগ ও সরকার লড়াই করে যাচ্ছে পুলিশ, বিজিবি আর র‌্যাবের মাধ্যমে। তাই আমরা প্রতিদিন টিভিতে পুলিশ আর র‌্যাবের বক্তৃতা শুনি।
প্রশ্ন হলোÑ বাজেটের বেনিফিট কাদের কাছে পৌঁছে? কারা বেনিফিসিয়ারি তা ইতোমধ্যে আপনারা কিছুটা আঁচ করতে পেরেছেন। একজন চৌকিদারও এই বাজেটের বেনিফিট পান। পান না শুধু এ দেশের কোটি কোটি সাধারণ কৃষক ও কৃষি উৎপাদক শ্রেণী। এ দেশে কৃষকদের কোনো শক্তিশালী সংগঠন নেই। কৃষক ছাড়া বাকি সবার দরকষাকষির সংগঠন আছে। দেশে লাখ লাখ মানুষ আছেন, যারা কখনো টাকা দেখেন না বা তাদের টাকার (কারেন্সি) প্রয়োজন হয় না। তারা শ্রমের বিনিময়ে চাল পান, দুপুরের খাবার পান। ধানের চাতালে যে সব মা-বোন কাজ করেন, তারা দিনের শেষে মজুরি হিসেবে চাল পান। বর্গা আর প্রান্তিক চাষিদের অবস্থা খুবই শোচনীয়। বড় চাষি বা কৃষক বা জমির মালিকেরা শুধু চাষের ওপর নির্ভর করেন না, তাদের আরো অনেক ব্যবসায় আছে। তাদেরই শিতি ছেলেমেয়েরা চাকরি করেন। তাদের হাতে নগদ অর্থ থাকে। আমাদের অর্থনীতি এখনো কৃষি ও কৃষকদের পে নয়। ফলে সরকারের বা রাজনৈতিক দলগুলোর দর্শন, আদর্শ ও কর্মসূচি কৃষকদের পে নয়। বহু বছর আগে জিয়া সাহেবের আমলে যখন আজিজুল হক সাহেব কৃষি উপদেষ্টা ছিলেন, তখন কৃষি মন্ত্রণালয়ের একটি কমিটি আমাকে প্রশ্ন করেছিলÑ আমি কৃষির পে না কৃষকের প।ে কমিটি আমাকে জানাল, সরকার কৃষি বা খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কাজ করছে। আপনার কাগজ তো কৃষকদের স্বার্থের জন্য কাজ করছে। আমরা মনে করি আপনি কৃষকদের উসকানি দিচ্ছেন। এই তথ্য থেকেই আপনারা বুঝতে পারছেন, বাংলাদেশ সরকারের আদর্শ কী এবং কোন পথে। পাকিস্তানের ২৩ বছর আর বাংলাদেশের ৪০ বছর মিলিয়ে ৬৩ বছর পার হতে চলেছে। কিন্তু কৃষকদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। ফলে দেশের যে উন্নতি ও অগ্রগতি হওয়ার কথা ছিল, তা হয়নি। কৃষকদের সজাগ করার জন্য কাজ করে অনেকেই সরকারি পুরস্কার পান। কৃষি এখনো দেশের ৬০ ভাগ মানুষের কর্মসংস্থান করে। এর মানে হলোÑ কোন পথ অবলম্বন করলে দেশের অর্থনীতি স্বাধীন হবে, সে পথে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো চলছে না। আপনারা ইতোমধ্যেই জানতে পেরেছেন বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। ফলে ধানের দাম একেবারেই পড়ে গেছে। লাভ হবে মিল মালিক ও কৃষিপণ্যে বিনিয়োগকারীদের। শোনা যাচ্ছে, কৃষকেরা এবার সর্বস্বান্ত হবেন। বেশি উৎপাদন একটি মহা আনন্দের খবর হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু হয়েছে বেদনার খবর। বেশি ফলন আমাদের কৃষকদের বহুকাল থেকে কষ্ট দিচ্ছে শুধু সরকারের নীতির ফলে। পৃথিবীর বহু দেশ এ সমস্যার সমাধান করেছে কৃষকদের কল্যাণার্থে। সে সব দেশের অর্থনীতিও বিকশিত হয়েছে কৃষকদের সমর্থনে। জাপান পৃথিবীর অন্যতম প্রধান শিল্পোন্নত দেশ হওয়া সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক চাপের মুখেও কৃষি ত্যাগ করেনি। নয়া কৃষিনীতির কারণে জাপানের কৃষকেরা এখন খুবই সুখে আছেন। জাপানের এক শ’ ভাগ কৃষকই এখন আধুনিক শিল্পপণ্যের ভোক্তা। কৃষিতে যত বেশি ভর্তুকি, তত বেশি শিল্পের বিকাশ। জাপান ও ভিয়েতনামের কৃষকেরা এখন সবচেয়ে সম্মানিত নাগরিক। আমাদের দেশের কৃষকদের কোনো সম্মান নেই। কারণ তারা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী নন। সুতরাং এই বাজেটের সাথে কৃষকদের কোনো সম্পর্ক নেই। চলমান সরকার ও রাজনৈতিকব্যবস্থা কৃষকদের মিত্র নয়। দেশের ষোলো বা পনেরো কোটি মানুষের ভেতর দুই-তিন কোটির সম্পর্ক রয়েছে বাজেটের সাথে। এমন ধরনের বাজেট হাজার বছরেও কৃষকের কল্যাণ বয়ে আনবে না। 
লেখক : কবি ও সাংবাদিক
ershadmz40@yahoo.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন