॥ এরশাদ মজুমদার ॥
রাজা-বাদশাহদের যুগ পেরিয়ে আমরা আধুনিক যুগে এসেছি বলে ঢোল পিটিয়ে দেশে-বিদেশে সবাই বলছেন। একসময়ে রাজারা দিগ্বিজয়ে বের হতেন। জোর করে অন্যের দেশ দখল করতেন, আর বাহবা পেতেন। আমরা আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের নাম জানি। তিনি গ্রিসের মেসিডোনিয়া থেকে দেশ জয় করতে করতে ভারতবর্ষের উত্তরে এসেছিলেন। সে কথা আমরা জানি পুরুর সাথে তার যুদ্ধের গল্প থেকে। পরাজিত পুরুকে নাকি আলেকজান্ডার জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনি আমার কাছে কী ধরনের ব্যবহার আশা করেন। পুরু নাকি বলেছিলেন, রাজার কাছে রাজা যেমন ব্যবহার পেতে পারেন, সে রকম। পুরুর কথা শুনে আমরা খুব খুশি। হেরে গেলেও আমাদের রাজার সাহস আছে। সে সময়ে ভারতীয়রা এ ধরনের বহুবার বহু জায়গায় হেরেছে আর বিদেশীদের জয়গান গেয়েছে। এই তো দেখুন না, রাম বলে কেউ নেইÑ এ কথা বহুবার বলা হয়েছে। স্বয়ং কবিগুরু বলেছেন, রামের জন্ম কবির মনোভূমিতে। কিন্তু কে কার কথা শোনে। কবি কল্পনা করে রামায়ণ নামের মহাকাব্য লিখেছেন। সেই কাব্যই এখন প্রায় ধর্মগ্রন্থে পরিণত হয়েছে। বিদেশী রাজার এমন বিজয়গাথা জগতে কেউ কখনো দেখেছে কি না জানি না। শেষ পর্যন্ত বিদেশী বিজয়ী রাজাকে অবতার ও দেবতা বানানো হয়েছে। আর দেশী পরাজিত রাজা রাবণকে বানানো হয়েছে রাস। তেমনি বিদেশী দখলদার ইংরেজদের আমরা আজো স্মরণীয়-বরণীয় মনে করি। আজো আমরা কমনওয়েলথের সদস্য। এর অর্থ একদিন আমরা তাদের দখলে ছিলাম এবং তাদের প্রজা ছিলাম, সে কথা আমরা জোর গলায় জাহির করছি। এখনো আমাদের দেশের লোক স্যার টাইটেল পেলে খুশিতে আটখানা হয়ে যান। দেশী ভাইবেরাদরের সহযোগিতায় ইংরেজরা এই দেশটাকে ১৯০ বছর শাসন ও শোষণ করেছে। কী ধরনের শোষণ করেছে তা এখন আমাদের বন্ধুবান্ধব ও নতুন প্রজন্মের
সন্তানেরা হয়তো ভুলে গেছে। আমাদের নতুন প্রজন্মের সন্তানেরা ইতিহাস নিয়ে তেমন মাথা ঘামায় না। তারা আজ নিয়ে ভাবে। গতকাল নিয়ে ভাবে না। হয়তো এমন অনেক তরুণ আছে, যারা ভালো করে দাদার নামও জানে না। হয়তো ওই নামটা তার কখনো প্রয়োজন হয়নি। হয়তো দাদা একেবারেই নগণ্য একজন মানুষ ছিলেন। তাই বাপ তার নিজের বাপের পরিচয় দিতে লজ্জা পেতেন। হয়তো বা ধনী হয়ে নিজের অতীতকে মুছে দিয়েছেন। এমন তরুণ বা তাদের বাবাদের ইতিহাস না জানলেও চলে। এ কারণেই আমাদের ইতিহাস নিয়ে এত কথা। প্রায় সবাই বলছেন, ইতিহাস বিকৃতি হচ্ছে। কোনটা সত্য ইতিহাস তা নিয়ে আমরা বিভ্রান্ত। যে দল যখন মতায় আসে, সে দল নিজের মতো করে ইতিহাস বলে। একদল বলে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। যদিও আমরা কেউ তার ঘোষণা শুনিনি। আদালত বলেছেন, বঙ্গবন্ধুই ঘোষণা দিয়েছেন। তাই এ নিয়ে আর কোনো কথা চলবে না। হাজার হলেও আদালতের ফরমান। ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধুর ইতিহাস নিয়ে প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদ বেকায়দায় পড়েছেন। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী হুমায়ূনকে লেখা বদলাতে হবে। এত দিন হুমায়ূন বানিয়ে বানিয়ে গল্প লিখতেন। কিন্তু ইতিহাস নিয়ে লিখতে গিয়েই ধরা পড়ে গেলেন।
জাতি হিসেবে আমাদের বায়া দলিল অর্থাৎ ইতিহাস আজো বিতর্কিত। কোনটা সঠিক, তা আজ আর বোঝা যায় না। আমি প্রায়ই বলি, জমির যদি বায়া দলিল থাকে, বংশের যদি বায়া দলিল থাকে, তাহলে দেশের বায়া দলিল থাকবে না কেন? আমরা তো আজো সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি, আমরা কি শুধুই বাঙালি, না বাঙালি মুসলমান। বিশ্ববাঙালি নামে এখন নতুন স্লোগান শুনতে পাচ্ছি। বিদেশের মাটিতে বিশ্ববাঙালি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সারা বিশ্বের বাঙালিরা উপস্থিত হন। এই সম্মেলনে যারা উপস্থিত হন, তাদের মধ্যে শুধু বাংলাদেশীদেরই একটি স্বাধীন রাষ্ট্র আছে, বাকি বাঙালিদের কোনো রাষ্ট্র নেই। পৃথিবীর ৩০ কোটি বাঙালির মধ্যে ১৫ কোটি বাঙালির কোনো স্বাধীন রাষ্ট্র বা দেশ নেই। পরাধীন বাঙালিরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাস করেন ও কাজ করেন। বিদেশি যারা বাস করেন তারা কেউ ভারতীয়, কেউ ব্রিটিশ বা কেউ অন্য কোনো দেশের। বাঙালি হলেও সবাই বাংলাদেশী নন। এমনকি আমাদের উপজাতিরাও নিজেদের বাঙালি মনে করেন না। জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধু যখন আহ্বান জানালেন, তোরা পাহাড়িরা সবাই বাঙালি হয়ে যা। তখন মানবেন্দ্র লারমা প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিলেন, আমরা বাঙালি নই। আমরা বাংলাদেশী।
রাজনীতির প্রধানতম উদ্দেশ্যই নাকি মতায় যাওয়া। কারণ, মতায় না গেলে আদর্শ বা উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করা যায় না। তাই মতায় যাওয়ার জন্য রাজনীতির প্রয়োজন। দল ছোট হোক বা বড় হোক, রাজনীতি করলে একদিন মতায় যাওয়া যাবেই। তার প্রমাণ মতাসীন মহাজোট। শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া মন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন কোনো দিনও দেখেননি। ভোট করে তিন-চার শ’র বেশি ভোট পান না। ভগবান বুদ্ধ বড়ুয়ার দিকে মুখ তুলে চেয়েছেন। তাই দিলীপ বড়ুয়া আজ মন্ত্রী। মেনন ও ইনুরও একই অবস্থা। মতায় যাওয়ার জন্য কৌশলগত কারণে নিজের মার্কা ত্যাগ করে নৌকা মার্কায় নির্বাচন করেছেন। ২০০৮ সালের ওই নির্বাচনে জয়লাভ ছিল ১০০ ভাগ গ্যারান্টেড। মেনন একবার জিয়ার আমলে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। ইনুর সে সুযোগও হয়নি। জীবনে একবারো এমপি বা সংসদ সদস্য হননি এমন অজানা-অচেনা লোকেরাও মন্ত্রী হয়েছেন। উর্দুতে একটা কথা আছেÑ ‘খোদা মেহেরবান তো, গাধা ভি পাহলোয়ান।’ শেখ হাসিনা যার ওপর খুশি হয়েছেন তিনিই মন্ত্রী হয়ে গেছেন। নির্বাচন না করেও মন্ত্রী হয়েছেন। নির্বাচনে যারা শলা দিয়েছিলেন জেতার জন্য তারাও আজ মন্ত্রীর পদমর্যাদায় উপদেষ্টা। লোকে বলে উপদেষ্টাদের মতা নাকি মন্ত্রীদের চেয়ে হাজার গুণ বেশি। শেখ হাসিনার মতা আছে তাই তিনি নিকট-দূর বহু আত্মীয়স্বজনকে পাহলোয়ান বানিয়ে দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর আমলেও তার আত্মীয়স্বজনেরা মতার স্বাদ পেয়েছিলেন। শুনেছি, গণচীনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইকে বিদেশী সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করেছিলেন, আপনার জীবনে সাফল্যের প্রধান কারণ কী? চৌ উত্তরে বলেছিলেন, আমি আত্মীয়দের সব সময় দূরে রেখেছি। শহীদ জিয়ার েেত্রও তাই শুনেছি। জিয়া নাকি আত্মীয়স্বজনদের কখনোই কাছে ঘেঁষতে দেননি। শেরে বাংলা অখণ্ড বঙ্গদেশের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে নিজের এক অযোগ্য ভাগিনাকে চাকরি দিয়েছিলেন। সংসদে এ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, প্রার্থীর যোগ্যতা সে প্রধানমন্ত্রীর ভাগিনা। বঙ্গবন্ধুর ভাগিনারাও তার মতায় থাকাকালে নানা ধরনের সুযোগ পেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতিকেও নাকি তিনি রাতারাতি সচিব বানিয়ে দিয়েছিলেন। নাম নাজানা বেয়াই সাহেবও মন্ত্রী হয়েছেন। মতা থাকলে বা মতায় থাকলে মতাবানেরা নিজের নামে এবং আত্মীয়স্বজনের নামে অনেক কিছু করেন। টাকা কিন্তু জনগণের, জনগণের নামে বিদেশ থেকে ধার করে আনা অথবা জনগণের কাছে আদায় করা টাকা। পাকিস্তান আমলে অনেক নাম বদলে গেছে। বাংলাদেশ আমলে সেসব আবার বদলেছে। যেমন ধরুন, ইংরেজ আমলে ব্যবসায় ছিল হিন্দুর, পাকিস্তান আমলে সেটা হয়েছে অবাঙালি মুসলমানের। বাংলাদেশ হওয়ার পর সেই ব্যবসায় হয়ে গেল বাঙালি আওয়ামী মুসলমানদের। মতার ধারা এমনিই চলে। আপনার মতা থাকলেই হলো। আইনের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত মতা, না হয় দলের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত মতা। রাজনীতি করলেও আপনার এই মতা থাকতে পারে, আবার রাষ্ট্র আপনার হাতে বা পাশে থাকলেও হতে পারে।
রাজনীতি না করেও মতায় আসা যায়। যেমন সামরিক আইন জারি করে, দেশের সংবিধান বাতিল করে সেনাপ্রধান মতায় আসতে পারেন। সেখানে তার সমর্থক থাকবেন সৈনিকেরা, আর সেনা অফিসারেরা। পাকিস্তান আমল থেকে আমাদের দেশে বহুবার সামরিক শাসন জারি হয়েছে। সেনাপ্রধানেরা মতায় এসে রাষ্ট্রপ্রধান, প্রেসিডেন্ট বা রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর ইন্তেকালের (স্থান পরিবর্তন) পর সামরিক শাসন জারি করে তারই বন্ধু খোন্দকার মোশতাক মতায় আসেন। তাকে সমর্থন দিয়েছে সেনাবাহিনী ও আওয়ামী লীগের একাংশ। পরে সেই মতা হাতবদল হয়ে চলে যায় সে সময়ের সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়ার কাছে। এর মধ্যে একমাত্র জেনারেল জিয়াই ছিলেন জনপ্রিয় শাসক। সেটা প্রমাণিত হয়েছে তার জানাজায় লাখো মানুষের অংশগ্রহণে। এ দেশে কারো জানাজায় এত মানুষের সমাগম হয়নি। জেনারেল জিয়াকে যারা দেখতে পারেন না, তাদের মত অবশ্য ভিন্ন। সামরিক আইন নিয়ে জাস্টিস মুনিমের একটি বই আছে। এটা ছিল তার পিএইচডি থিসিস। জেনারেল আইউবের সামরিক আইন জারি নিয়ে লিখতে গিয়ে তিনি সামরিক আইনের ইতিহাস বর্ণনা করেছেন। ইংল্যান্ডে প্রথম রাজারা এই আইন ব্যবহার করেন। তবে বলা হয়েছে, এটা কোনো আইন নয়। যুদ্ধের সময়েই শুধু এ আইন ব্যবহার করা যেতে পারে,
শান্তির সময় নয়। জেনারেল আইউব যখন সামরিক আইন জারি করে মতা দখল করেছিলেন, তখন কোনো যুদ্ধাবস্থা ছিল না। এই তো কিছু দিন আগে জেনারেল মইন দেশে জরুরি অবস্থা জারি করতে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রফেসর ইয়াজউদ্দিনকে বাধ্য করেন। জেনারেল মইন একটা সিভিল সরকার নিয়োগ করে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সারা দেশে সেনা অফিসাররা প্রশাসন চালানোর দায়িত্ব নেন। দুর্নীতির মূলোচ্ছেদ করার নামে দেশের অর্থনীতিকে তছনছ করে ফেলেন। দেশের মানুষ মনে করে, জরুরি অবস্থা জারি করার প্রেতি তৈরি করেছে গোয়েন্দা বাহিনী। আর আওয়ামী লীগ বিশৃঙ্খল অবস্থা সৃষ্টির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। অথবা বলা যেতে পারে, জেনারেল মইনের মতা গ্রহণকে আওয়ামী লীগ সমর্থন করেছে। আর এ জন্য পুরস্কার হচ্ছে ২০০৮ সালের নির্বাচন। একসময় বলা হতো, ‘মাইট ইজ রাইট’। জোর যার মুল্লুক তার। মাঝখানে মনে হয়েছিল, সেসব দিন বাসি হয়ে গেছে। না, এখনো সেসব দিন বাসি হয়নি। এখনো শক্তি থাকলে উপায় হয়। রাষ্ট্রশক্তি থাকলে তো কথাই নেই। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো একটি রাষ্ট্র যদি কারো দখলে থাকে, তাহলে তো আর কথাই নেই। যিনি মতায় থাকবেন বা মতা দখল করবেন, রাষ্ট্র তার কথামতো চলবে। কিন্তু বলা হবে, আইনের শাসন চলছে। আগেই বলেছি, আইন তো তৈরি হয়েছে যারা রাষ্ট্র চালাবেন তাদের স্বার্থ রার জন্য। এমন দেশে জনগণের নামে সব কিছু হবে, কিন্তু জনগণ থাকবে না।
জেনারেল আইউব গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠিয়ে, রাজনীতিকদের হেনস্তা করে প্রায় দশ বছর মতায় ছিলেন। পরে আন্দোলনের মুখে জেনারেল ইয়াহিয়ার কাছে মতা দিয়ে বিদায় নিয়েছিলেন। আর জেনারেল ইয়াহিয়া সাধারণ নির্বাচন দিয়েও পাকিস্তানকে রা করতে পারেননি। বাংলাদেশের জেনারেল এরশাদও গণরোষের মুখে পদত্যাগ করে জেলে গিয়েছিলেন। এখনো তার বিরুদ্ধে বহু মামলা রয়েছে। এরশাদ মতা দখল করে বলেছিলেন, তিনি দিল্লির সাথে কথা বলেছেন। আওয়ামী লীগও এরশাদকে সমর্থন করেছিল। ’৮৬ সালের নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ এরশাদের সাথে হাত মিলিয়েছিল। এখনো এরশাদ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের সাথে রয়েছেন। মূলত এরশাদের মতার উৎসস্থল হচ্ছে দিল্লি। দিল্লি বাংলাদেশে ছোট-বড় তিন-চারটি পলিটিক্যাল টিম রেখে রাজনীতির মাঠে খেলাধুলা করে। জেনারেল আইউব মতা দখল করে বেসিক ডেমোক্রেসি চালু করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু একদলীয় শাসন চালু করেছিলেন নিজের মতাকে পোক্ত করার জন্য। এখন শেখ হাসিনা বলছেন, তিনি জানেন কিভাবে বিরোধী দলকে সোজা পথে আনতে হয়। কোথায় যেন এক টুকরো খবর দেখলাম, প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় বলেছেন, আগামী ২৫ বছরে বাংলাদেশে হিন্দু প্রধানমন্ত্রী হয়ে প্রমাণ করবেন, বাংলাদেশ একটি মহান সেকুলার দেশ। দিল্লির উসকানিতে বাংলাদেশকে সেকুলার ভূতে পেয়েছে। আওয়ামী লীগ এ বিষয়টা গভীরভাবে অনুধাবন করতে পারছে না, দিল্লিকে তুষ্ট করার জন্য আওয়ামী লীগ মতায় এসেই নানা ধরনের মামলায় জড়িয়ে পড়েছে। প্রায় চার বছর পার করতে চলেছে বর্তমান সরকার শুধু মামলা নিয়েই নিজেদের ব্যস্ত রেখেছে। দেশের উন্নয়ন নিয়ে সরকারের কোনো মাথাব্যথা নেই। সরকারের সামনে দেশের মানুষ নেই, বিরোধী দল নেই। অবিষয়কে বিষয় বানিয়ে সরকার নিজেকে ব্যস্ত রেখেছে। যেমন ধরুনÑ গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. ইউনূস সমস্যা । কেন যে হঠাৎ গ্রামীণ ব্যাংক সরকারের জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে তা দেশবাসী বুঝতে পারছে না। শেখ হাসিনার একটি সুবিধা আছে, তা হলোÑ তিনি যা বলেন, তার পারিষদ বলেন তার হাজার গুণ বেশি। লোককথা হচ্ছেÑ এক শিয়ালে ডাক দিলে শত শিয়াল হুক্কা হুয়া শুরু করে। কোনো শিয়ালই কারণ-অকারণ জানতে চায় না। এটা অবশ্য দলের জন্য খুব ভালো। আমরা যারা ৫০ বছর ধরে আওয়ামী সংস্কৃতি ও ঘরানার রাজনীতি দেখে আসছি, ল করেছি যে, এখানে শক্তিই প্রধান দর্শন, যুক্তি বা জ্ঞান কখনোই কাজ করেনি।
দল হিসেবে আওয়ামী লীগের চরিত্র আর দেশ হিসেবে আমেরিকার চরিত্র প্রায় একই রকম। জোর করে আদর্শ প্রচার করা উভয়েরই সংস্কৃতি। আমেরিকার ৮০ শতাংশ মানুষই অতি সাধারণ, দেশের রাজনীতি বা রাজনীতিবিদদের নিয়ে তারা কখনোই চিন্তা করে না। তারা নিয়মিত সপ্তাহের মজুরি পেলেই খুশি। দেশ কারা চালায়, কিভাবে চালায় তা নিয়ে আমেরিকার সাধারণ মানুষের কোনো মাথাব্যথা নেই। ফলে দু’টি রাজনৈতিক দলের কিছু নেতা আর ধনীরা দেশটা চালায়। ফলে আমেরিকা সারা পৃথিবীকে অশান্ত করে রেখেছে। প্রতিনিয়ত সারা পৃথিবীর মানুষকে ধমকের ওপর রেখেছে। কথা শুনতে বিভিন্ন দেশকে বাধ্য করছে। সেই আমেরিকাই আবার মানবতা, গণতন্ত্র, মানবাধিকার নিয়ে বিশ্ববাসীকে জ্ঞান দান করতে চায়। গণচীনের মতো দেশকেও আমেরিকা মানবতা ও গণতন্ত্র শিা দেয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে। নোবেল বিজয়ী বিশ্বখ্যাত জার্মান কবি গুন্টারগ্রাস বলেছেন, যে দেশের কাছে আণবিক বোমা নেই, সেই দেশকে শায়েস্তা করার জন্য আমেরিকা ও তার বন্ধুরা উঠেপড়ে লেগেছে। আর যার কাছে আণবিক বোমা আছে, তার ব্যাপারে কারো কোনো কথা নেই। মারণাস্ত্র আছে বলে ইরাকের সাদ্দামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে শান্ত দেশটাকে লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে। সেখানে এখন প্রতিনিয়ত মানুষ মারা যাচ্ছে। একই অবস্থা করেছে লিবিয়ার। এখন বলছে, ইরান আক্রমণের জন্য আমেরিকা প্রস্তুত। বিশ্বজনমত আমেরিকা ও তার বন্ধুদের বিরুদ্ধে, কিন্তু মতা জনমতের বিরুদ্ধে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মুসলিম লীগ করেছেন, পরে আওয়ামী মুসলিম লীগ করেছেন। মুসলিম শব্দ বাদ দিয়ে শুধু আওয়ামী লীগ করেছেন। কিন্তু কিছুতেই তিনি আরাম পাচ্ছিলেন না। শেষ পর্যন্ত একদলীয় শাসনব্যবস্থা চালু করার জন্য বাকশাল করে সব দল নিষিদ্ধ করেছিলেন। অথচ গণতন্ত্রের জন্য তিনি বছরের পর বছর জেল-জুলুম-নির্যাতন সহ্য করেছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার সময় তিনি পাকিস্তানের কারাগারে ছিলেন। সারা জীবন আমেরিকাকে সমর্থন করে বাংলাদেশে ফিরে এসে ভারতের অনুপ্রেরণায় একদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। মওলানা ভাসানী যখন পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের কথা বললেন, বঙ্গবন্ধুর নেতা সোহরাওয়ার্দী সাহেব বললেন, ৯৮ ভাগ স্বায়ত্তশাসন দেয়া হয়ে গেছে। আর যারা স্বায়ত্তশাসনের দাবিদার ছিলেন, তাদের লাঠিপেটা করার জন্য ধেয়ে গেছে বঙ্গবন্ধুর ভক্তরা। পরে দেখা গেল, বঙ্গবন্ধু নিজেই পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসনের দাবিদার হয়ে গেছেন। ’৭০-৭১ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু কখনোই সমাজতন্ত্রের সমর্থক ছিলেন না। কিন্তু বাংলাদেশ হওয়ার পর তিনি হয়ে গেলেন সবচেয়ে বড় সমাজতান্ত্রিক নেতা। রাশিয়া হয়ে গেল তার সবচেয়ে বড় বন্ধু দেশ।
কেউ কেউ বলেন, দণি এশিয়ায় আওয়ামী লীগ হলো সবচেয়ে শক্তিশালী বিরোধী দল। মতায় গেলেও আওয়ামী লীগ নিজেকে বিরোধী দলই মনে করে। আওয়ামী নেতারা নিজেরাই বলেন, ‘মতায় থাকলেও আমরা রাজপথ ছাড়ি নাই।’ ফলে, আওয়ামী লীগের দলীয় ভাষা মতায় এবং মতার বাইরে একই সমান।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক
ershadmz40@yahoo.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন