বৃহস্পতিবার, ২৪ মে, ২০১২

আর কত দিন মানবিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অপোয়




॥ এরশাদ মজুমদার ॥


আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থায় মানবতা ও মানবাধিকার বিষয়টি তেমন গুরুত্ব পায় না। এর আগেও আমি এ বিষয়ে লিখেছি। আমাদের রাষ্ট্র্র মানুষের চেয়ে অনেক বড়। রাষ্ট্রকে আমাদের নেতারা অনেক বেশি মতা দিয়ে ফেলেছেন। মানুষের কল্যাণ ও মঙ্গলের ব্যাপারে আমাদের রাষ্ট্র্রের কোনো দর্শন নেই। রাষ্ট্র্র একটি আধুনিক ব্যবস্থা। জনগণের মতায়ন ও অধিকার প্রতিষ্ঠার চিন্তা থেকেই রাষ্ট্র্রব্যবস্থার জন্ম হয়েছে। বড় বড় দার্শনিক ও রাষ্ট্র্রবিজ্ঞানের পণ্ডিতেরা আধুনিক রাষ্ট্র্রব্যবস্থার প্রচারক ছিলেন। ইতোমধ্যেই এই ব্যবস্থা বেশ পুরনো হয়ে গেছে। কিছু লেখক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী ও চিন্তকজন এই ব্যবস্থা ঘুণেধরা বুর্জোয়া শোষণকামী ব্যবস্থা বলে গালাগাল দিচ্ছেন। কমিউনিস্ট রাষ্ট্র্রব্যবস্থা মানুষের চাহিদা পূরণ করতে পারেনি। প্রায় এক শ’ বছর ধরে এই ব্যবস্থা নিয়ে কমিউনিস্ট নেতারা পরীা-নিরীা চালিয়েছেন। সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের মাধ্যমে কমিউনিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার ব্যবহারিক দিকের পতন হয়েছে; কিন্তু দর্শন হিসেবে এটা এখনো জীবিত। আমি মনে করি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র্রব্যবস্থার চিন্তকেরা ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন। এই তো ক’দিন আগেই কার্ল মার্কসের দেড় শ’ বছর পালিত হয়েছে। জগদ্বিখ্যাত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী হিসেবে চে’কে তরুণেরা ভুলতে পারে না। চে’র ছবিওয়ালা টি-শার্ট এখনো তরুণদের খুবই প্রিয়। ইয়েমেনের তরুণেরাও চে’র ছবি নিয়ে মিছিল করছে। 
কার্ল মার্কস নিজেই ইসলামকে রেডিক্যাল ধর্ম হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এর আগেও আমি বলেছি, মার্কস যদি পুরো কুরআন শরীফ পড়তেন, তাহলে হয়তো তিনি ডাস ক্যাপিটাল এভাবে রচনা না করে কিছুটা আরো মানবিক করে তুলতে পারতেন। পবিত্র কুরআন শরীফে আল্লাহ ও বান্দাহ সম্পর্কিত আয়াত বা বাণী অতি অল্প। জগতের সব ধর্মীয় কিতাবই দাবি করেছে মানুষকে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। সব ধর্মের মানুষই বিশ্বাস করে মানুষ আল্লাহ, ভগবান, ঈশ্বর, গড, ইলোহা, ইলাহা কর্তৃক সৃষ্ট। কিতাবও এসেছে যুগে যুগে। শেষ কিতাব হচ্ছে আল কুরআন। কিছু মানুষ পুরনো কিতাব এবং এর ধ্যানধারণাকে আঁকড়ে ধরে আছে। নতুন কিতাব আল কুরআনের আবেদনকে মেনে নেয়নি। হয়তো এটাই মানুষের ভাগ্য। সেমিটিক ধর্মগুলো মূলত একই সূত্রে গ্রথিত। মূল সুর একই। হজরত ইবরাহিম সব জাতিরই পিতা। একই পিতার সন্তানেরা বিভিন্ন মতে বিভক্ত হয়ে গেছে। একে অন্যের সাথে মারামারি করছে। এমনকি আল কুরআন ও হজরত মুহাম্মদে যারা ঈমান এনেছেন তাদের ভেতরও অনেক বিভক্তি।
ইসলামকে ধর্ম মনে না করে একটা সামগ্রিক জীবনব্যবস্থা হিসেবে মনে করেও নতুন দুনিয়ার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। এর মধ্যে ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ইতোমধ্যেই বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। অন্য ধর্মাবলম্বীরাও ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে মেনে নিয়েছে। ইসলামে রাষ্ট্রব্যবস্থা, বিচার, চিকিৎসা, শিা, কৃষি, শিল্প, নির্বাচন, সরকার গঠন, প্রশাসন, সম্পদ বণ্টন, ওয়ারিশয়ানাসহ সব বিষয়ে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। এসব বিষয়ে গবেষণার দুয়ারও খোলা রাখা হয়েছে। দেড় হাজার বছর আগে ইসলামই প্রথম মানবতা ও মানবাধিকার নিয়ে কথা বলেছে। আল্লাহর রাসূল হজরত মুহাম্মদ সা: এ জগতে সর্বপ্রথম অধিকারহারা সাধারণ মানুষের রাষ্ট্র্র প্রতিষ্ঠা করেন। সেই রাষ্ট্র্র শুধু মুসলমানদের জন্য ছিল না। সেই রাষ্ট্রে সব ধর্মমতের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সে সময়ে সাধারণ মানুষের অধিকার বা রাষ্ট্রের কোনো ধারণাই ছিল না। মুসলমানেরা সে ধরনের কোনো রাষ্ট্র্র আজো প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। পূর্ণাঙ্গ ইসলামিক রাষ্ট্র্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। যেমন আমাদের রাষ্ট্র্র বাংলাদেশ। এ রাষ্ট্রের কোনো দর্শন বা আদর্শ আমি দেখতে পাই না। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের প্রধানতম সমস্যা হলো এ দেশের মানুষ মুসলমান। হাজার বছর ধরেই মুসলমান। সামাজিক মর্যাদা, সম-অধিকার পাওয়ার আশাতেই তখনকার মজলুম মানুষগুলো ইসলাম গ্রহণ করেছে। এর আগে ধর্মীয় বর্ণবাদ তাদের শোষণ করত। তখন ইসলামের মতো প্রগতিশীল আর কোনো ধর্ম, মতবাদ বা দর্শন ছিল না। তখন সমাজে সাধারণ মানুষ মুক্ত ছিল না। রাষ্ট্রও ছিল না, গণতন্ত্রও ছিল না। মতাবানেরাই দেশ ও সমাজ চালাত। যার শক্তি ছিল সেই ছিল শাসক বা রাজা-বাদশাহ। আধুনিক রাষ্ট্র্রব্যবস্থার ধারণা নিয়ে এসেছে ইংরেজেরা এ দেশে, যা অচল হতে চলেছে। নতুন কোনো ব্যবস্থা দৃশ্যমান নয় বলেই পুরনো অচল ব্যবস্থাটাই চলছে। আমাদের বাংলাদেশ ওই পুরনো ব্যবস্থাতেই চলছে। যে ব্যবস্থায় এক ভোট বেশি পেয়েই একজন নির্বাচিত হন। সংসদের এক সিট বেশি থাকলেই একটি দল বা গ্রুপ মতা দখল করে। ভোট পাওয়ার প্রশ্নে কোনো নিয়মনীতি বা নৈতিকতার ব্যাপার নেই। সোজা কথায় ভোট পেলেই হলো। কিভাবে পেয়েছে তা বিবেচ্য বা বিচার্য বিষয় নয়। নেতা নির্বাচনে নৈতিকতার বিষয়টা এখন আর কোনো গুরুত্ব্পূর্ণ বিষয় নয়। নেতার গুণের বিষয়টাও গুরুত্বপূর্ণ নয়। ভোট পেলেই হলো। ফলে আমাদের জাতীয় সংসদে এখন আর তেমন ভালো মানুষ নেই। ’৪৬ বা ’৫৪-তে যারা নির্বাচিত হয়েছিলেন এখন সে ধরনের মানুষের কোনো প্রয়োজন নেই। নমিনেশনের সময়ই বলা হয় টাকা না থাকলে নমিনেশন পাওয়া যাবে না। তাহলে আমরা জানতে পারলাম এক নম্বর যোগ্যতা টাকা। তারপরের যোগ্যতা কত মোটরসাইকেল, জিপ আর অস্ত্র আছে। সর্বশেষ যোগ্যতা হলো প্রার্থীর নিয়ন্ত্রণে কত মাস্তান আছে। একসময় নির্বাচনে প্রার্থীরা ছিলেন উকিল ও সমাজসেবী। এখন যেকোনো লোকই হতে পারেন। একবার নির্বাচিত হলেই তিনি বা তারা সমাজের এলিটে পরিণত হন। আর নির্বাচিত না হলেও তারা সাবেক এমপি, মন্ত্রী ও উপদেষ্টা। সবার বাড়ির সামনে নেমপ্লেট থাকে সাবেক অমুক। তাদের ছেলেমেয়দেরও সমাজে দাম বাড়ে। আমাদের মতো দেশে যারা মতায় থাকবেন তাদের মানবাধিকার থাকবে। আর থাকবে রাষ্ট্রের ও রাষ্ট্রের কর্মচারীদের। আপনি যদি ক্ষমতার বাইরে থাকেন তাহলে পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাবসহ আরো যারা আছে সবাই গায়ে হাত তুলতে পারবে। আপনার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা দিতে পারবে। আপনি সাবেক মন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রী হলেও কিছু আসে যায় না। আপনারা নিয়মিত টিভিতে দেখেন পুলিশের কী মতা আছে! পুলিশ সরকার, সরকারের আমলা, সরকারের সব রকমের শালা ছাড়া সবার গায়ে হাত তোলার অধিকার রাখে। পুলিশ খুব বিনয়ের সাথে বলবে, স্যার, আমরা রাষ্ট্রের গোলাম, আর রাষ্ট্র্র চালায় সরকার। রাষ্ট্রের আইন আর সরকারের নির্দেশেই আমরা আপনাদের গায়ে হাত তুলি। বলতে পারেন আমরা জনগণের খাদেম। জনগণের প্রতিনিধি হলেন নির্বাচিত সরকার। আরো বলবে, স্যার, রাষ্ট্র্র আর সরকারের খেদমত করা মানেই মানবতার খেদমত করা আর মানবাধিকার রা করা। আপনি যদি বলেন সংবিধান আমার সব মৌলিক অধিকার রক্ষা করছে। তখন পুলিশ অফিসার বলবে, স্যার, ওসব কাগুজে কথা। কাগজে তো কত কথাই লেখা থাকে। শুধু কাগজে থাকলেই কি দখলি স্বত্ব থাকে? না, থাকে না। এই তো দেখুন না, বিরোধী দলের চিফ হুইফ জয়নুল আবদিনের কী হাল হয়েছিল? তাকে যে পুলিশ অফিসার কিলঘুষি মেরেছিলেন তিনি প্রমোশন পেয়ে গেছেন। রাজনীতিতেও তাই, যিনি যত বেশি পুলিশের কিলঘুষি খাবেন তিনি তত বেশি উন্নতি লাভ করবেন। এই তো দেখুন না, সরকারি দলের এক নেত্রী যখন বিরোধী দলে ছিলেন, তখন বিনা কারণেই রাস্তায় শুয়ে পড়তেন। তিনি তো এখন খুবই সম্মানিত একজন মন্ত্রী। আপনারা মার খেয়ে, জেলে গিয়ে মন্ত্রী হন, আর আমরা মার দিয়ে, জেলে পাঠিয়ে প্রমোশন পাই। একেই বলে রাষ্ট্র্রব্যবস্থা। রাষ্ট্র্র থাকলে তার কতগুলো পোশাক থাকতে হয়। তেমনি পোশাক হলো মানবতা, মানবাধিকার, আইন আদালত ও সংসদ। রাষ্ট্র্র থাকলে সভ্য বলে গণ্য হওয়ার জন্য এসব রাখতে হবে এবং পরতে হবে। এই তো দেখুন না নামজাদা ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমদ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে উপন্যাস লিখতে গিয়ে ফেঁসে গেছেন। আদালত উপন্যাসটি শুদ্ধ করে লেখার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। দেয়াল নামক ইতিহাসভিত্তিক উপন্যাসটি লেখার জন্য প্রকাশক হয়তো অগ্রিম দিয়ে বসে আছেন। এ ছাড়া হুমায়ূন ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য বিদেশে থাকার সময় প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের প্রচুর ভালোবাসা পেয়েছেন বলে আমরা মিডিয়ার মাধ্যমে জানতে পেরেছি। হয়তো ভালোবাসার প্রতিদান দিতে গিয়েই এখন আদালতের ভালোবাসা নিতে হচ্ছে।
এই তো দেখুন, ক’দিন আগে বিরোধী জোটের ৩০-৩৫ জন নেতাকে জেলে পাঠানো হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে গাড়ি পোড়ানো ও বোমা ফাটানোর অভিযোগ এনেছে পুলিশ। আগেই বলেছি পুলিশ যারা মতায় থাকেন তাদের জন্য কাজ করেন। যদিও মাঝে মাঝে সরকারি কর্মচারীরা বলেন, আমরা রাষ্ট্রের কর্মচারী, কারো ভৃত্য নই। রাষ্ট্র্র যেহেতু যে বেশি ভোট পায় সেই চালায় তাই পুলিশসহ সব বাহিনী তাদের কথা শোনে। এখানে মানবাধিকার বা মানবতার কথা আসবে কেন। সরকার তো মানবতা আর মানবাধিকারের জন্য কাজ করছে। তাহলে সরকার বা তার বেতনভুক কর্মচারীরা শব্দ দু’টি লঙ্ঘন করবেন কেমন করে। যিনি বা যারা রা করেন তিনি বা তারা কিভাবে লঙ্ঘন-ভঙ্গন করবেন। সোজা কথায় বলা যেতে পারে পুলিশ ও সরকারি বাহিনী মনে করে সরকারের সমালোচক বা বিরোধী দলকে পেটানো, তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া তাদের পবিত্র দায়িত্ব। তারা তো এ কাজটি ব্রিটিশ আমল থেকেই করে আসছেন। ’৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণ- অভ্যুত্থানের সময়ও পুলিশ বাহিনী এ কাজটি খুবই দতার সাথে করেছে। আইন-আদালত তো ব্রিটিশ আমলেরই রয়ে গেছে। তাই আইনের কাছে সবার হাত-পা বাঁধা। চলমান আওয়ামী লীগ সরকার তো মহান পবিত্র মুক্তিযুদ্ধের সরকার। এ সরকারের সাথে নানা ধরনের পবিত্রতার সম্পর্ক রয়েছে। এই পবিত্রতা নিয়ে কোনো কথা বলা যাবে না। আমাদের আদালতও এখন মুক্তিযুদ্ধের আদালত। তাই বলতে হবে মহান মুক্তিযুদ্ধ, মহান আদালত, মহান বিচারপতি। এত দিন আমরা শুধু বলতাম মহান সেনাবাহিনী, এখন সবার নামের আগে মহান বা পবিত্র লেখা ভালো হবে বা মানানসই হবে। ব্রিটিশ আমলে মহান বা মহামান্য সরকার বাহাদুর বলে অনেকেই দামি দামি খেতাব পেয়েছেন। এখনো মহান মহামান্য সরকার বাহাদুর বললে সরকার খুশি হয় এবং নানা রকম পদক ও সম্মানী দেয়। হাজার হাজার বছর আগেও এসব রেওয়াজ ছিল। তখন রাজা-বাদশাহ ও শাসকদের গুণগ্রাহী খুবই কম ছিলেন। কারণ বেশির ভাগ প্রজা বা মানুষ ছিলেন অবোধ-অচেতন এবং অধিকারহারা। তারা জানতেন না মানবতা বা মানবাধিকার কাকে বলে। তারা জানতেন না প্রজা হিসেবে তাদের কোনো মতা আছে কি না। সাধারণ মানুষের ধারণা ছিল রাজা আর পারিষদ দেশ চালাবেন। এতে প্রজার কী করার আছে। প্রজারা কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। গ্রামের একজন চৌকিদারই ছিলেন সরকার বা বাদশাহর প্রতিনিধি।
মানবজাতির জন্য নির্ধারিত ও নির্দেশিত কিতাব আল কুরআন দেড় হাজার বছর আগেই ঘোষণা করেছে জগতে মানুষের চেয়ে বড় কিছু নেই। মানুষই শ্রেষ্ঠ, তাহার উপরে নেই। মানুষ তার স্রষ্টা ছাড়া কারো কাছে মাথা নত করবে না। মানুষকে পদানত করার জন্য যুগে যুগে হাজার বছর ধরে শক্তিমানেরা চেষ্টা চালিয়ে গেছে। সবাই মানুষের ঐক্যবদ্ধ শক্তির কাছে পরাজিত হয়েছে। কিন্তু শক্তিমানেরা যত দিন শক্তি থাকে, তত দিন এই সত্যটি বুঝতে পারে না বা বোঝার চেষ্টা করে না। মানুষের সার্বভৌমত্ব স্বাধীনতার এই খবরটি সুস্পষ্টভাবে আজো মানুষের কাছে পৌঁছেনি। এর মানে আল কুরআনের এই মহান বাণী জগতের ঘরে ঘরে পৌঁছেনি। আল্লাহর রাসূল হজরত মুহাম্মদ সা:-এর বাণী আজো সব মানুষের কাছে পৌঁছেনি। তাই মানুষের অন্তরের সব অন্ধকার আজো দূরীভূত হয়নি। প্রকৃতিগতভাবেই মানুষ স্বাধীন। তার চিন্তার স্বাধীনতা আরশিল আজিম পর্যন্ত। সেই মানুষকে শক্তির জোরে, খোদা বিরোধী আইনের জোরে যারা পরাভূত করে রাখতে চায় তারা খোদাদ্রোহী। তারা ফেরাউন, নমরুদ আর সাজ্জাদের বংশধর। কুরআন জানলেই মানুষ স্বাধীন হয়ে যাবে। জগতের কোনো কিছুই মানুষকে আর শৃঙ্খলিত করতে পারবে না। কুরআনের কাজ শুধু ভালো মানুষকে বেহেশত দান করা নয়। কুরআনের কাজ হচ্ছে, জগতে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করা। শুধু অল্পসংখ্যক মানুষ কুরআনের মর্মবাণী বুঝতে পেরেছে। তাই বিশ্বের সব ফেরাউন আজ ঐক্যবদ্ধ হয়েছে কুরআনের বিরুদ্ধে, সত্যের বিরুদ্ধে ও মানুষের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে। ফেরাউনি শক্তির ছায়া ও বাতাস বাংলাদেশেও এসে পৌঁছেছে। বুশ বা ওবামা ‘জিহাদ’ শব্দটিকে ভয় পান। বাংলাদেশেও শয়তানি শক্তি এই শব্দটিকে ভয় পায়। আপনারা প্রায়ই শুনবেন পুলিশ জিহাদি বইসহ অমুক জায়গা থেকে অতজনকে আটক করেছে। সেই জায়গায় বহু জিহাদি বই পাওয়া গেছে। কিন্তু আমরা জানি না ওই জিহাদি বইগুলো কী? ৫০ থেকে ৬০ দশকের দিকে আমরা যখন স্কুলে-কলেজে পড়তাম তখন ‘সোভিয়েত দেশ’ বা ‘পিকিং রিভিউ’ হাতে দেখলেই পুলিশ তাড়া করত। তখন বিশ্বব্যাপী সরকারগুলো কমিউনিজমকে ভয় পেত। ভাবতো এসব বই পড়লেই পোলাপাইন নষ্ট হয়ে যাবে। বাবা-মায়েরাও তাই মনে করতেন। পত্রপত্রিকাগুলোও ‘লালমিয়া’ বলে গালাগাল দিত। বিশ্বের ফেরাউনি শক্তি এখন ইসলাম ও কুরআনের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে। আল কুরআন নাকি মানুষকে সন্ত্রাসী করে তোলে। বিদ্রোহ-বিপ্লবের কথা বাদ দিয়ে কুরআন তাফসির বা ব্যাখ্যা করতে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। মুসলমান ও অমুসলমান সব সরকারই মনে করে কুরআনের জিহাদি আয়াতগুলো বাদ রাখা দরকার। ‘জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের বিদ্রোহ ফরজ।’ এটাই হচ্ছে আল কুরআনের পবিত্র বাণী। আল কুরআন হচ্ছে গণমানুষের মুক্তির সনদ।
আমাদের দেশটি আল্লাহর আইনে চলে না। চলে ব্রিটিশ আইন মোতাবেক। এসব কথা এর আগেও আমি আমার কলামে বহুবার বলেছি। সোনার বাংলার আদালত, বিচারব্যবস্থা, সরকারব্যবস্থা, সংসদÑ সব কিছুই চলে ব্রিটিশ আইনে। এ দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ মুসলমান। বেশির ভাগ মানুষ নিরর ও দরিদ্র। নিজেদের অধিকার সম্পর্কে তারা অবহিত নন। তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যই একদিন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়নি। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ৪০ বছর পার হয়ে গেছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের মুক্তি আসেনি। এমন রাষ্ট্র্রব্যবস্থায় মজলুমের মুক্তি নেই এ কথা তারা জানেন না। যে আলেম-ওলামারা ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছিলেন তাদের উত্তরসূরিরা এখন কোথায়? রাষ্ট্র্র স্বাধীন হলেই মানুষ স্বাধীন হয় না। তার বড় প্রমাণ পাকিস্তান ও বাংলাদেশ। বিশ্বে আরো বহু দেশ আছে যেখানে ভূগোল আর কিছু নেতা স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু মানুষ স্বাধীন হয়নি। এ কথা এখন নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয়ে গেছে যে, রাষ্ট্র্র স্বাধীন হলেই মানুষ স্বাধীন হয় না। প্রচলিত ধ্যানধারণা দিয়ে মানুষের সামগ্রিক মুক্তি কখনোই আসবে না। সরকারগুলো রাজা-বাদশাহ আর ফেরাউনদের প্রতিনিধি। সেই প্রতিনিধিদের আড্ডাখানা হলো জাতিসঙ্ঘ, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ইত্যাদি।
চলমান সরকারের জুলুম-নির্যাতন নিয়ে আমি তেমন মাথা ঘামাই না। দেশের প্রচলিত আইনই সরকারকে জুলুমবাজ করে তুলেছে। মানুষের নামে মানুষের কল্যাণের জন্য যেসব আইন তৈরি হয়েছে তা কখনোই মানুষের পে ছিল না, এখনো নেই। বারবার করে বলছি, বলেছি চলমান আইন দিয়ে এ দেশে কখনোই মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। এ দেশে সংসদকে বলা হয় সার্বভৌম। যেখানে নিয়মিত মানুষের বিরুদ্ধে আইন পাস হয়। যেখানে দিন-রাত অসত্য বাক্য বিনিময় হয়। আদালতেও মিথ্যা স্যা সত্য হিসেবে গৃহীত হয়। এমন সব আদালত যেখানে কোনো গরিব কোনো দিনও পৌঁছতে পারে না। কোন দল ভালো আর কোন দল মন্দ একজন কলাম লেখক হিসেবে এটা বিবেচনার দায়িত্ব আমার নয়। এখন মনে হচ্ছে চলমান সরকারের মতো এত অত্যাচার এর আগে কোনো সরকারই করেনি। এ কথা আমরা সব সময়ই বলে থাকি। আমি মনে করি, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য কলম ধরাই আমার প্রথম ও প্রধান কাজ। বাংলাদেশকে গণমানুষের রাষ্ট্রে পরিণত করতে হবে। সাধারণ মানুষ যখন বুঝবে এ রাষ্ট্রটা তার তখন সব দিক থেকেই দেশ উন্নতির দিকে এগিয়ে যাবে। জানি না, বাংলাদেশ গণমানুষের রাষ্ট্রে পরিণত হতে আর কত দিন লাগবে? 
লেখক : কবি ও সাংবাদিক
ershadmz40@yahoo.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন