॥ এরশাদ মজুমদার
পঞ্চাশ বছর ধরে আমি বাজেট রিপোর্টিং করছি। চলমান বাজেটব্যবস্থাকে আমি কখনো সমর্থন করিনি। চলমান বাজেট প্রণয়ন ও ব্যবস্থাপনায় সাধারণ মানুষের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হবে না। যদি হতো পাকিস্তানের ২৩ বছর আর বাংলাদেশের ৪০ বছরেই হতো। আমাদের বাজেটের কোনো ধরনের নৈতিক বা আদর্শগত দর্শন নেই। এ ধরনের বাজেট তৈরি করতে কোনো ধরনের ওস্তাদ বা এক্সপার্টের প্রয়োজন নেই। আমাদের দাদা-নানারা নিজেদের সংসার, জমিজিরাত ব্যবস্থাপনার জন্য যে প্রাকৃতিক জ্ঞান রাখতেন সে জ্ঞানও আমাদের বাজেটপ্রণেতাদের নেই। এমনও হতে পারে যে, তারা সেভাবে ভাবেন না। যেভাবে তারা বা আমি লেখাপড়া করেছি তাতে সাধারণ মানুষের কল্যাণ ও উন্নতি নিয়ে ভাবার কোনো উপায় নেই। দেং জিয়াও, মাহাথির, লি কুয়াং যা পারেন তা আমাদের নেতারা পারছেন না কেন? আমাদের নেতা, আমলা ও অর্থনীতিবিদদের কি সে রকম লেখাপড়া নেই? বর্তমানে বাজেট তৈরি করতে নাকি সরকারকে গলদঘর্ম হতে হয়। আমলারা নাকি রাতের ঘুম হারাম করে বাজেট তৈরি করেন। কিন্তু বাজেট যখন প্রকাশ করা হয় তখন দেখি এতে নতুন কিছুই নেই। পুরনো অঙ্কগুলোকে ১০, ১৫, ২০ পারসেন্ট বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
বাজেট তৈরি করা শুরুর আগে সরকার ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিকসহ আরো অনেক তদবির মহলের সাথে মতবিনিময় করেন। সব মহলেরই তদবির বা লবি করার মতো শক্তিশালী সংগঠন আছে। তাদের কথা সরকারকে শুনতে হয়। সাংবাদিক বুদ্ধিজীবীদের কথা শুনতে হয়, তা না হলে তারা হাউকাউ লাগিয়ে দেবেন। সামরিক নেতারা মতায় এসে সব সময় বলেন, সাংবাদিকেরা আমার সংসদ। তাদের সাথে কথা বলা মানে জনগণের সাথে কথা বলা। শাইখ সিরাজ বাজেটের আগে কৃষকদের কথা বলার রেওয়াজ শুরু করেছিলেন তার ফলাফল কী তা দেশবাসী জানে না। শাইখ সিরাজের চেষ্টা এবং উদ্যোগকে আমি ধন্যবাদ জানাই। তবুও তিনি একটা ধারণা তৈরি করেছেন যে বাজেটের আগে কৃষকদের সাথে কথা বলা দরকার। ’৭২ সালের কথা বলছি। লোহানী ভাই তখন বাংলাদেশ বেতারে। সদ্য স্বাধীন দেশ, তাই এর অর্থনীতি নিয়ে কিছু আশা-ভরসার কথা লিখতে অনুরোধ করলেন। কয়েকটা লেখা লিখেছিলাম। যার জন্য আমি কোনো টাকা নিইনি। কিন্তু লেখা বন্ধ করলাম কেন? শব্দ ব্যবহার নিয়ে আমার সাথে কর্তাব্যক্তিদের দ্বিমত হলো। কৃষক শব্দ ব্যবহার করা যাবে না। বলতে হবে চাষি বা চাষাভূষা। এমন আরো বহু শব্দ ছিল। পাকিস্তান আমলে রেডিও ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে। রেডিওর ভাষা ব্যবহারের রীতি ও নীতি নির্ধারিত হতো ইসলামাবাদে। বাংলাদেশ হওয়ার পরও ইসলামাবাদের ভূতটা চট করে পালিয়ে যায়নি। চলমান বাজেট ১৬ কোটি মানুষের নামে তৈরি হলেও এটা মূলত মাত্র কিছু মানুষের জন্য, যারা রাষ্ট্রের বন্ধু এবং রাষ্ট্রের তহবিলের সদস্য। রাষ্ট্র একজন পুলিশ বা চৌকিদারের যে যতœ নেয় তেমন যতœ কোনো নাগরিকের নেয়া হয় না। ৬৩ বছরেও যাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি তারা ধরে নিয়েছেন বা মেনে নিয়েছেন আল্লাহ তায়ালাই তাদের এমন করে তৈরি করেছেন। পরম করুণাময় আল্লাহর বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে অভিমান করে একদিন এই জগৎ ত্যাগ করে। যে রাষ্ট্র স্বাধীনতা, মানবাধিকার, মৌলিক অধিকারের নামে কোটি কোটি মানুষকে যুগের পর যুগ শোষণ করে সে রাষ্ট্র কখনোই একটি কল্যাণমুখী রাষ্ট্র নয়। খাদ্য, শিা, বাসস্থান ও চিকিৎসা হলো যেকোনো মানুষের খোদা প্রদত্ত মৌলিক অধিকার। এ অধিকার কোনো রাষ্ট্র বা শাসক খর্ব করতে পারে না। যারা এ অধিকার খর্ব করে তারা হলো স্বেচ্ছাচারী ডিক্টেটর অথবা অযোগ্য। তাদের মুখোশ গণতন্ত্র হোক আর সমাজতন্ত্র হোক। তারা নমরুদ ফেরাউন আর সাদ্দাদের বংশধর।
১৯৭১ সালে যে স্লোগান দিয়ে বা যে আশা দিয়ে নেতারা স্বাধীনতার কথা বলেছিলেন, সেই আশা আজো বাস্তবায়িত হয়নি। রাষ্ট্র জনগণের কাছে যে ওয়াদা করেছে তা বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে। আমি বলব, রাষ্ট্রের দর্শন গণমুখী নয়। নেতারা জানে না একটি গণকল্যাণমুখী রাষ্ট্র কিভাবে প্রতিষ্ঠা করতে হয়। অথবা তারা জেনেও জনগণকে ধোঁকা দিয়েছেন। মাহাথির, লি কুয়াং যদি পেরে থাকেন তাহলে আমাদের নেতারা পারেন না কেন? অনেকেই বলেন, জিয়া সাহেব বেঁচে থাকলে হয়তো তিনি পারতেন। জিয়া সাহেবের একটি স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে মর্যাদার আসনে বসানোর জন্য। কিন্তু তাকে সে সময় দেয়নি দেশের শত্রুরা। অনেকেই বলবেন, আমি বঙ্গবন্ধুর কথা বলছি না কেন? গাফ্ফার চৌধুরী সাহেব তো বঙ্গন্ধুকে রাখাল রাজা বলেছেন। তিনি মানুষকে ভালোবাসতেন, এ ব্যাপারে কারো সন্দেহ থাকা উচিত নয়। কিন্তু জনকল্যাণমুখী সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তিনি নিজে কোনো ভাবনা বা পরিকল্পনা আমাদের সামনে রেখে যেতে পারেননি। তিনি সব সময় আবেগ আবিষ্ট ছিলেন। তিনি আমলাদের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। সমাজতন্ত্র সম্পর্কে তার সুস্পষ্ট কোনো ধারণা ছিল না। পরে আমলারা রাতারাতি সমাজতন্ত্রী হয়ে গেলেন। তারাই বিপ্লবের সৈনিক হয়ে গেলেন। শ্রদ্ধেয় মনি বাবুর দল ও আমলারা দল পাকিয়ে বঙ্গবন্ধুকে একদলীয় শাসন বাকশাল কায়েম করতে বাধ্য করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল, কিন্তু তিনি জানতেন না কিভাবে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করবেন। কিছু আমলা এখনো বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনাকে ঘিরে রেখেছে। সোজা কথায় বলতে গেলে দৃশ্যমান ভারতপন্থী কিছু লোক ও অদৃশ্য আরো কিছু লোক হাসিনার নামে বাংলাদেশ চালাচ্ছে। এমনটিই এখন লোকে ভাবে। আমার তো মনে হয় প্রধানমন্ত্রী ও তার দলের লোকেরা মনে করেন, আমরা মতায় থাকব, দেশ কে চালায় সেটা বড় কথা নয়। দেশ চললেই হলো। এমন চলাতে দেশের সাধারণ মানুষের কোনো উন্নতি হয় না। ফলে তাদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয় না। বাংলাদেশও তেমনি একটি দেশ। যেখানে কিছু লোক দেশ চালায় আর তারা এবং তাদের বন্ধুরাই দেশটাকে লুটেপুটে খায়। এবারের বাজেটের ১৭.২ শতাংশ খরচ হয়ে যাবে পুরনো ঋণের সুদ শোধ করতেই। এর মানে সরকার ১৬ কোটি মানুষ আর রাষ্ট্রটা দেখিয়ে বিদেশ ও স্বদেশ থেকে যে ঋণ নিয়েছেন সেই ঋণের সুদ শোধ করতে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা চলে যাবে। সরকারের চলতি খরচ চালাতে মানে কর্মচারীর বেতন, গাড়ি-বাড়িতেই খরচ হবে এক লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা। উন্নয়নের জন্য রাখা হয়েছে মাত্র ৫৬ হাজার চার শ’ কোটি টাকা। বাজে খরচ যাকে ইংরেজিতে বলে মিসলেনিয়াস আছে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি, আনসার ও র্যাবের জন্য রয়েছে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা। কৃষি খাতের চলমান ব্যয়ের জন্য বরাদ্দ রয়েছে পাঁচ হাজার কোটি টাকার মতো। উন্নয়ন বাজেটের মধ্যেও বাজে খরচ (অন্যান্য) রয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা। এই বাজেটে ৫০ হাজার কোটি টাকার ওপরে কর্জ নেয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এক লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকার বাজেটের জন্য ৫০ হাজার কোটি টাকা ধার করতে হবে। সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, গাড়ি-বাড়ি, পেনশন ও অন্যান্য খাতে ব্যয় করতে হবে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা। এর মানে ধার করে কর্মচারীর বেতন দেয়া। আগেই বলেছি, সরকার চালাতেই যদি বেশি টাকা খরচ হয় উন্নয়নের জন্য টাকা আসবে কোত্থেকে? আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এখন বেশির ভাগ সময় কাটে ভিআইপিদের নিরাপত্তা দিতে। এরপর যেটুকু সময় থাকে তা ব্যয় করতে হয় বিরোধী দলকে ঠেঙ্গাতে। গত কয়েক মাসে পুলিশ এবং র্যাবের বিরুদ্ধে যেসব খবর বেরিয়েছে তাতে এসব বাহিনীর ওপর দেশের মানুষের আর কোনো আস্থা নেই। আদালতে বিচারের জন্য গেলে পুলিশ ধরে নিয়ে ধর্ষণ করে। বিচারককে কনস্টেবল পেটায়। অনেকে হয়তো বলবেন, এ রকম ঘটনা আরো ঘটে। র্যাবের এক বড় সাহেব তো পীরের দরবারের অর্থসম্পদ লুট করে এখন জেলে আছেন। অপর দিকে ভারত সীমান্তে প্রতিদিন বাংলাদেশীদের হত্যা করা হচ্ছে। বিদেশীরাও এখন এর প্রতিবাদ করছেন। কিন্তু আমাদের সরকার গভীর বন্ধুত্বের কারণে আর চুলজ্জায় মুখ খুলে কিছু বলতে পারছেন না। রাষ্ট্র থাকলে একটা সরকার লাগে। আর সরকার থাকলে তার পুলিশ, মিলিটারি, র্যাব, আনসারসহ নানা রকমের গোয়েন্দা বাহিনী লাগে। সর্বোপরি থাকে একটা বিরাট আমলা বাহিনী। সরকার মানে তো ৩৩০ জন এমপি আর ৫০-৬০ জন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী। তারা দেশের জন্য কী কাজ করেন তা আমরা সহজে বুঝতে পারি না। কিন্তু মুখ খুললেই দেখি বিরোধী দলের বিরুদ্ধে খিস্তিখেউড় করছেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রী নিজেও সারা দিন বিরোধী দলের বিরুদ্ধে লেগে থাকেন। সরকারি দল এবং প্রধানমন্ত্রীর কথা শুনে মনে হয় বিরোধী দলের কাজ হচ্ছে সরকারি দলকে সমর্থন করা। এই একই মানসিকতা থেকেই বঙ্গবন্ধু একদলীয় শাসনব্যবস্থা বাকশাল চালু করেছিলেন। বর্তমান আওয়ামী লীগ এখন আর বঙ্গবন্ধুর একদলীয় শাসন আদর্শে বিশ্বাস করে না।
প্রস্তাবিত বাজেটকে সরকারি দল ছাড়া কেউই সমর্থন করেননি। এমনকি সরকার সমর্থক বা আওয়ামী ঘরানার অর্থনীতিবিদেরাও এই বাজেটকে সমর্থন করেননি। ১/১১-এর কেয়ারটেকার সরকারের দুই নেতা জেনারেল মইন আর ফখরুদ্দীন (যারা নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন) ছাড়া বাকি সবাই নামের সাথে তকমা লাগিয়ে চার দিকে ঘুরে বেড়াচ্ছেন এবং নানা বিষয়ে দেশবাসীকে পরামর্শ দিচ্ছেন। তেমনি একজন মানুষ হচ্ছেন মির্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি নিয়মিত সেমিনারে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াচ্ছেন। এসব ভদ্রলোকই ওই সময়ে দেশের বিরাট তি করেছেন। জনসাধারণ তাদের কথা ভুলে গেছেন। তারাও বেহায়ার মতো কথা বলে চলেছেন। কই একজনও তো এ কথা বলেননি যে, সে সময়ে তারা বাধ্য হয়ে মন্দ কাজগুলো করেছেন বা মন্দ কাজের জন্য জাতির কাছে মাও চাননি। মির্জ্জা আজিজও বলেছেন, বিগত বছরের প্রায় সব ইকোনমিক ইন্ডিকেটরই নেগেটিভ। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমেছে, ডলার এক্সচেঞ্জ রেটও ১১ ভাগ কমেছে। প্রায় সব েেত্রই প্রবৃদ্ধি ও অগ্রগতি পেছন দিকে ছুটছে। তবুও আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলে চলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকার অনেক কাজ করেছেন যা সাংবাদিক ও বিরোধী দল দেখতে পায় না। সরকারি হিসাব এবং পরিসংখ্যানই বলেছে প্রবৃদ্ধি অনেক েেত্র নেগেটিভ। মির্জা সাহেব তার লেখায় বিষয়টা বিস্তারিতভাবে খোলাসা করেছেন। সিপিডিসহ আরো অনেক সংগঠন বলেছে বাজেট অবাস্তব। প্রধানমন্ত্রী তো বলেছেন তার ভালো কাজগুলো বিরোধী দল নষ্ট করে দেয়। তিনি গাছ লাগালে বিরোধী দল ফল খায়। আমি আমার লেখায় বহুবার বলেছি, কোনো রাজনৈতিক সরকার মতায় না থাকলেও প্রবৃদ্ধি হয়। প্রশ্ন তা কী রকম প্রবৃদ্ধি? বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হওয়া দরকার গড়ে ১০ শতাংশ। কিন্তু কোনো সরকারই এ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারেনি। যখন অরাজনৈতিক সরকার মতায় থাকে তখনো প্রবৃদ্ধি ৪-৫ শতাংশ হয়। এর মানে হচ্ছে সরকারি উদ্যোগ না থাকলেও জনগণের চেষ্টায় অর্থনীতির চাকা চলতে থাকে। ফলে কিছুটা প্রবৃদ্ধি একেবারে থেমে যায় না। ক’দিন আগে সৈয়দ আশরাফ বলেছেন আওয়ামী লীগকে আরো দুইবার নির্বাচিত করার জন্য। তাহলে তারা বাংলাদেশকে মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের মতো করে দেবেন। সৈয়দ সাহেবকে বলব, আপনি একজন মাহাথির ও একজন লি কুয়াং এনে দিন। বলুন বাংলাদেশে লি কুয়াং বা মাহাথির কে? বঙ্গবন্ধু এ কাজটি হয়তো পারতেন। বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য তিনি পারেননি। তিনি নিজেই বলেছেন, তার চার দিকে চাটার দল। তিনি বিদেশ থেকে যা আনেন চাটার দল সব খেয়ে ফেলে। তিনি আরো বলেছেন, সাত কোটি কম্বল রিলিফ এসেছিল কিন্তু তিনি তো পাননি। তাহলে তার ভাগেরটা কোথায় গেল? আমি নিশ্চিতভাবেই বলব, তার স্বপ্ন ছিল সোনার বাংলা গড়ার, কিন্তু অ্যাবিলিটি ছিল না। ফলে তার আমলেই দেশে দুর্ভি হয়েছিল এবং লাখ লাখ মানুষ না খেয়ে মারা গেছে। সে সময়ে গরিবের খাদ্য লুট করে বহু মানুষ ধনী হয়েছে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায়। তিনি দেশ ও দেশের মানুষকে ভালোবাসতেন এ ব্যাপারে কারো কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়। কিন্তু একজন প্রেমিক কখনোই উত্তম শাসক হতে পারেন না। বঙ্গবন্ধুকে পা ধরে সালাম করেই অনেকের কপাল খুলে গেছে। তিনি ভেবেছিলেন একদলীয় গণতন্ত্র চালু করলেই তিনি জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তন করতে পারবেন। এর মানে তিনি তখন সমালোচনা সহ্য করতে পারছিলেন না। তিনি না বুঝেই সমাজতন্ত্র চালু করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি নিজে যা ভালো মনে করেছিলেন তাই করেছেন। তিনি খবরের কাগজ বন্ধ করেছিলেন। তিনি সরকারি কর্মচারীদের রাজনীতিতে জড়িত করেছিলেন। তিনি যখন সমাজতন্ত্র চালু করার চেষ্টা করেছিলেন তখন সমাজতন্ত্রের মরণদশা। এখন তো চীন, রাশিয়াতেই সমাজতন্ত্র নেই।
গত ৪০ বছরে রাজনৈতিক নেতা ও তাদের বন্ধুরাই বিত্তবান হয়েছেন বাংলাদেশে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, দেশের মানুষের ক্রয়মতা বেড়েছে। কথাটা সত্যি। ’৭০ সালে যার দুই টাকা দিনমজুরি ছিল সে পাচ্ছে তিন শ’ থেকে চার শ’ টাকা। পরিবারের সদস্য সংখ্যা পাঁচ-ছয়জন। বৃদ্ধ মা-বাপ থাকলে তাদেরও দেখতে হয়। গরিবের বস্তি ভাড়া এখন দুই থেকে চার হাজার টাকা। বস্তির জায়গাগুলো বেশির ভাগই সরকারের। রাজনৈতিক মাস্তানরাই সব জায়গা ভাড়া দিয়ে খায়। দলগুলো মিছিলের জন্য এখান থেকেই লোক সংগ্রহ করে। ফুটপাথ, রেলস্টেশন, বাসস্ট্যান্ড, লঞ্চঘাটসহ বহু খালি জায়গায় মানুষ থাকে। রাজধানীতে নাকি এখন ৫০ লাখ মানুষ এসব এলাকায় থাকে। প্রতি বছর চার থেকে পাঁচ লাখ লোক রাজধানীতে আসে। গ্রামেও একই অবস্থা। দশ থেকে বারো কোটি লোক গ্রামে থাকে। এর ভেতর রয়েছে কৃষিশ্রমিক, হাটবাজারের দিনমজুর, ভিুক, ুদ্র ব্যবসায়ী। এদের সবারই নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। এরা ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাতে পারে না। ফলে তাদের জীবন থেকে অশিা দারিদ্র্য আর কখনোই যায় না। একটা জাতির সব মানুষকে নিররতা ও দারিদ্র্যমুক্ত করতে ৬৪ বছর লাগার কথা নয়। দেশের জনসাধারণ বিশেষ করে গরিব দিনমজুর ও নিম্নমধ্যবিত্তদের অবশ্যই বুঝতে হবে রাজনীতি, সরকারব্যবস্থা ও রাষ্ট্রীয় দর্শনে কোথাও বিরাট গলদ রয়ে গেছে। রাজনীতিবিদ, সংসদ সদস্য, আমলা, সরকার ও রাষ্ট্রের বন্ধুদের সবার বাড়ি-গাড়ি, ধনসম্পদ আছে এবং তা দিন দিন বেড়েই চলেছে। ধনীরা সচিব, জেনারেল, মন্ত্রী, সংসদ সদস্যদের সাথে আত্মীয়তা করেন। এমনকি আওয়ামী নেতাদের সাথে জামায়াত, মুসলিম লীগ ও বিএনপি নেতাদের আত্মীয়তা আছে এবং নতুন করেও হচ্ছে।
শুরুতেই বলেছি, বাজেটের বর্তমান দর্শন ও ব্যবস্থাপনায় এ দেশের গরিবের ভাগ্য পরিবর্তন হবে না। কারণ এ বাজেট সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য তৈরি করা হয় না। সোজা কথায় বলা যেতে পারে, এ বাজেট সাধারণ মানুষের জন্য নয়। এই তো ক’দিন আগেই আমরা সবাই দেখলাম, প্রাইমারি স্কুলের শিকেরা পুলিশের হাতে কিভাবে লাঞ্ছিত হয়েছেন। জলকামান দিয়ে তাদের শায়েস্তা করা হয়েছে। প্রাইমারি স্কুলের শিকেরা আর ক’ টাকাই বা বেতন পান। তাদের কাছে লেখাপড়া করেই তো সবাই প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, সচিব, বিচারপতি, জেনারেল হন। সবার জন্য বাজেটে বিরাট বিরাট বরাদ্দ। শুধু প্রয়োজনীয় বরাদ্দ নেই শিকদের জন্য। জনপ্রতিনিধির নামে মন্ত্রী-এমপিরা শুল্কমুক্ত দামি গাড়ি পান, সরকারি দামে দামি জমি পান। হয়তো তাদের অনেকেরই শিকদের মতো লেখাপড়াই নেই। বাজেটে কৃষি, বাসস্থান ও চিকিৎসার জন্য তেমন বরাদ্দ নেই। সরকার ও রাষ্ট্রের সাথে যাদের সম্পর্ক আছে তাদের সবার জন্যই বরাদ্দ আছে। আমার প্রশ্ন হলো, এ অঞ্চলের বাঙালি বা মুসলমান বাঙালিরা কেন স্বাধীন হয়েছে ৪০ বছর আগে। ৪০ বছর ধরেই সর্বহারা থাকার জন্য? তাদের চিকিৎসা, বাসস্থান, খাদ্য, বস্ত্র কিছুই তো হয়নি ৪০ বছরে। তাদের ছেলেমেয়েরা অল্পস্বল্প লেখাপড়া করলেও চাকরি পায় না।
আরেকটি কথা আমি অবশ্যই বলব, ভাগ্যের দোহাই দিয়ে গরিব মানুষদের আর ধোঁকা দেবেন না। চোর ডাকাত আর বদমায়েশদের ভ্যগ্যের পরিবর্তন হবে সাধারণ মানুষের হবে না এমন সমাজ নিশ্চয়ই আমরা প্রত্যাখ্যান করি। এমন সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা শত বছরেও গরিবদের ভাগ্যের পরিবর্তন করতে পারবে না। বর্তমান শোষণমুখী রাষ্ট্রব্যবস্থায় সাধারণ মানুষের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হবে না। সত্যি কথা বলতে কী, বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থা অকল্যাণকর এক ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক
ershadmz40@yahoo.com