শুক্রবার, ২২ জুন, ২০১২

বাজেট : সেদিন এদিন ও আগামী দিন


॥ এরশাদ মজুমদার 


পঞ্চাশ বছর ধরে আমি বাজেট রিপোর্টিং করছি। চলমান বাজেটব্যবস্থাকে আমি কখনো সমর্থন করিনি। চলমান বাজেট প্রণয়ন ও ব্যবস্থাপনায় সাধারণ মানুষের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হবে না। যদি হতো পাকিস্তানের ২৩ বছর আর বাংলাদেশের ৪০ বছরেই হতো। আমাদের বাজেটের কোনো ধরনের নৈতিক বা আদর্শগত দর্শন নেই। এ ধরনের বাজেট তৈরি করতে কোনো ধরনের ওস্তাদ বা এক্সপার্টের প্রয়োজন নেই। আমাদের দাদা-নানারা নিজেদের সংসার, জমিজিরাত ব্যবস্থাপনার জন্য যে প্রাকৃতিক জ্ঞান রাখতেন সে জ্ঞানও আমাদের বাজেটপ্রণেতাদের নেই। এমনও হতে পারে যে, তারা সেভাবে ভাবেন না। যেভাবে তারা বা আমি লেখাপড়া করেছি তাতে সাধারণ মানুষের কল্যাণ ও উন্নতি নিয়ে ভাবার কোনো উপায় নেই। দেং জিয়াও, মাহাথির, লি কুয়াং যা পারেন তা আমাদের নেতারা পারছেন না কেন? আমাদের নেতা, আমলা ও অর্থনীতিবিদদের কি সে রকম লেখাপড়া নেই? বর্তমানে বাজেট তৈরি করতে নাকি সরকারকে গলদঘর্ম হতে হয়। আমলারা নাকি রাতের ঘুম হারাম করে বাজেট তৈরি করেন। কিন্তু বাজেট যখন প্রকাশ করা হয় তখন দেখি এতে নতুন কিছুই নেই। পুরনো অঙ্কগুলোকে ১০, ১৫, ২০ পারসেন্ট বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
বাজেট তৈরি করা শুরুর আগে সরকার ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিকসহ আরো অনেক তদবির মহলের সাথে মতবিনিময় করেন। সব মহলেরই তদবির বা লবি করার মতো শক্তিশালী সংগঠন আছে। তাদের কথা সরকারকে শুনতে হয়। সাংবাদিক বুদ্ধিজীবীদের কথা শুনতে হয়, তা না হলে তারা হাউকাউ লাগিয়ে দেবেন। সামরিক নেতারা মতায় এসে সব সময় বলেন, সাংবাদিকেরা আমার সংসদ। তাদের সাথে কথা বলা মানে জনগণের সাথে কথা বলা। শাইখ সিরাজ বাজেটের আগে কৃষকদের কথা বলার রেওয়াজ শুরু করেছিলেন তার ফলাফল কী তা দেশবাসী জানে না। শাইখ সিরাজের চেষ্টা এবং উদ্যোগকে আমি ধন্যবাদ জানাই। তবুও তিনি একটা ধারণা তৈরি করেছেন যে বাজেটের আগে কৃষকদের সাথে কথা বলা দরকার। ’৭২ সালের কথা বলছি। লোহানী ভাই তখন বাংলাদেশ বেতারে। সদ্য স্বাধীন দেশ, তাই এর অর্থনীতি নিয়ে কিছু আশা-ভরসার কথা লিখতে অনুরোধ করলেন। কয়েকটা লেখা লিখেছিলাম। যার জন্য আমি কোনো টাকা নিইনি। কিন্তু লেখা বন্ধ করলাম কেন? শব্দ ব্যবহার নিয়ে আমার সাথে কর্তাব্যক্তিদের দ্বিমত হলো। কৃষক শব্দ ব্যবহার করা যাবে না। বলতে হবে চাষি বা চাষাভূষা। এমন আরো বহু শব্দ ছিল। পাকিস্তান আমলে রেডিও ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে। রেডিওর ভাষা ব্যবহারের রীতি ও নীতি নির্ধারিত হতো ইসলামাবাদে। বাংলাদেশ হওয়ার পরও ইসলামাবাদের ভূতটা চট করে পালিয়ে যায়নি। চলমান বাজেট ১৬ কোটি মানুষের নামে তৈরি হলেও এটা মূলত মাত্র কিছু মানুষের জন্য, যারা রাষ্ট্রের বন্ধু এবং রাষ্ট্রের তহবিলের সদস্য। রাষ্ট্র একজন পুলিশ বা চৌকিদারের যে যতœ নেয় তেমন যতœ কোনো নাগরিকের নেয়া হয় না। ৬৩ বছরেও যাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি তারা ধরে নিয়েছেন বা মেনে নিয়েছেন আল্লাহ তায়ালাই তাদের এমন করে তৈরি করেছেন। পরম করুণাময় আল্লাহর বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে অভিমান করে একদিন এই জগৎ ত্যাগ করে। যে রাষ্ট্র স্বাধীনতা, মানবাধিকার, মৌলিক অধিকারের নামে কোটি কোটি মানুষকে যুগের পর যুগ শোষণ করে সে রাষ্ট্র কখনোই একটি কল্যাণমুখী রাষ্ট্র নয়। খাদ্য, শিা, বাসস্থান ও চিকিৎসা হলো যেকোনো মানুষের খোদা প্রদত্ত মৌলিক অধিকার। এ অধিকার কোনো রাষ্ট্র বা শাসক খর্ব করতে পারে না। যারা এ অধিকার খর্ব করে তারা হলো স্বেচ্ছাচারী ডিক্টেটর অথবা অযোগ্য। তাদের মুখোশ গণতন্ত্র হোক আর সমাজতন্ত্র হোক। তারা নমরুদ ফেরাউন আর সাদ্দাদের বংশধর।
১৯৭১ সালে যে স্লোগান দিয়ে বা যে আশা দিয়ে নেতারা স্বাধীনতার কথা বলেছিলেন, সেই আশা আজো বাস্তবায়িত হয়নি। রাষ্ট্র জনগণের কাছে যে ওয়াদা করেছে তা বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে। আমি বলব, রাষ্ট্রের দর্শন গণমুখী নয়। নেতারা জানে না একটি গণকল্যাণমুখী রাষ্ট্র কিভাবে প্রতিষ্ঠা করতে হয়। অথবা তারা জেনেও জনগণকে ধোঁকা দিয়েছেন। মাহাথির, লি কুয়াং যদি পেরে থাকেন তাহলে আমাদের নেতারা পারেন না কেন? অনেকেই বলেন, জিয়া সাহেব বেঁচে থাকলে হয়তো তিনি পারতেন। জিয়া সাহেবের একটি স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে মর্যাদার আসনে বসানোর জন্য। কিন্তু তাকে সে সময় দেয়নি দেশের শত্রুরা। অনেকেই বলবেন, আমি বঙ্গবন্ধুর কথা বলছি না কেন? গাফ্ফার চৌধুরী সাহেব তো বঙ্গন্ধুকে রাখাল রাজা বলেছেন। তিনি মানুষকে ভালোবাসতেন, এ ব্যাপারে কারো সন্দেহ থাকা উচিত নয়। কিন্তু জনকল্যাণমুখী সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তিনি নিজে কোনো ভাবনা বা পরিকল্পনা আমাদের সামনে রেখে যেতে পারেননি। তিনি সব সময় আবেগ আবিষ্ট ছিলেন। তিনি আমলাদের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। সমাজতন্ত্র সম্পর্কে তার সুস্পষ্ট কোনো ধারণা ছিল না। পরে আমলারা রাতারাতি সমাজতন্ত্রী হয়ে গেলেন। তারাই বিপ্লবের সৈনিক হয়ে গেলেন। শ্রদ্ধেয় মনি বাবুর দল ও আমলারা দল পাকিয়ে বঙ্গবন্ধুকে একদলীয় শাসন বাকশাল কায়েম করতে বাধ্য করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল, কিন্তু তিনি জানতেন না কিভাবে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করবেন। কিছু আমলা এখনো বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনাকে ঘিরে রেখেছে। সোজা কথায় বলতে গেলে দৃশ্যমান ভারতপন্থী কিছু লোক ও অদৃশ্য আরো কিছু লোক হাসিনার নামে বাংলাদেশ চালাচ্ছে। এমনটিই এখন লোকে ভাবে। আমার তো মনে হয় প্রধানমন্ত্রী ও তার দলের লোকেরা মনে করেন, আমরা মতায় থাকব, দেশ কে চালায় সেটা বড় কথা নয়। দেশ চললেই হলো। এমন চলাতে দেশের সাধারণ মানুষের কোনো উন্নতি হয় না। ফলে তাদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয় না। বাংলাদেশও তেমনি একটি দেশ। যেখানে কিছু লোক দেশ চালায় আর তারা এবং তাদের বন্ধুরাই দেশটাকে লুটেপুটে খায়। এবারের বাজেটের ১৭.২ শতাংশ খরচ হয়ে যাবে পুরনো ঋণের সুদ শোধ করতেই। এর মানে সরকার ১৬ কোটি মানুষ আর রাষ্ট্রটা দেখিয়ে বিদেশ ও স্বদেশ থেকে যে ঋণ নিয়েছেন সেই ঋণের সুদ শোধ করতে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা চলে যাবে। সরকারের চলতি খরচ চালাতে মানে কর্মচারীর বেতন, গাড়ি-বাড়িতেই খরচ হবে এক লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা। উন্নয়নের জন্য রাখা হয়েছে মাত্র ৫৬ হাজার চার শ’ কোটি টাকা। বাজে খরচ যাকে ইংরেজিতে বলে মিসলেনিয়াস আছে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি, আনসার ও র‌্যাবের জন্য রয়েছে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা। কৃষি খাতের চলমান ব্যয়ের জন্য বরাদ্দ রয়েছে পাঁচ হাজার কোটি টাকার মতো। উন্নয়ন বাজেটের মধ্যেও বাজে খরচ (অন্যান্য) রয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা। এই বাজেটে ৫০ হাজার কোটি টাকার ওপরে কর্জ নেয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এক লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকার বাজেটের জন্য ৫০ হাজার কোটি টাকা ধার করতে হবে। সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, গাড়ি-বাড়ি, পেনশন ও অন্যান্য খাতে ব্যয় করতে হবে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা। এর মানে ধার করে কর্মচারীর বেতন দেয়া। আগেই বলেছি, সরকার চালাতেই যদি বেশি টাকা খরচ হয় উন্নয়নের জন্য টাকা আসবে কোত্থেকে? আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এখন বেশির ভাগ সময় কাটে ভিআইপিদের নিরাপত্তা দিতে। এরপর যেটুকু সময় থাকে তা ব্যয় করতে হয় বিরোধী দলকে ঠেঙ্গাতে। গত কয়েক মাসে পুলিশ এবং র‌্যাবের বিরুদ্ধে যেসব খবর বেরিয়েছে তাতে এসব বাহিনীর ওপর দেশের মানুষের আর কোনো আস্থা নেই। আদালতে বিচারের জন্য গেলে পুলিশ ধরে নিয়ে ধর্ষণ করে। বিচারককে কনস্টেবল পেটায়। অনেকে হয়তো বলবেন, এ রকম ঘটনা আরো ঘটে। র‌্যাবের এক বড় সাহেব তো পীরের দরবারের অর্থসম্পদ লুট করে এখন জেলে আছেন। অপর দিকে ভারত সীমান্তে প্রতিদিন বাংলাদেশীদের হত্যা করা হচ্ছে। বিদেশীরাও এখন এর প্রতিবাদ করছেন। কিন্তু আমাদের সরকার গভীর বন্ধুত্বের কারণে আর চুলজ্জায় মুখ খুলে কিছু বলতে পারছেন না। রাষ্ট্র থাকলে একটা সরকার লাগে। আর সরকার থাকলে তার পুলিশ, মিলিটারি, র‌্যাব, আনসারসহ নানা রকমের গোয়েন্দা বাহিনী লাগে। সর্বোপরি থাকে একটা বিরাট আমলা বাহিনী। সরকার মানে তো ৩৩০ জন এমপি আর ৫০-৬০ জন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী। তারা দেশের জন্য কী কাজ করেন তা আমরা সহজে বুঝতে পারি না। কিন্তু মুখ খুললেই দেখি বিরোধী দলের বিরুদ্ধে খিস্তিখেউড় করছেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রী নিজেও সারা দিন বিরোধী দলের বিরুদ্ধে লেগে থাকেন। সরকারি দল এবং প্রধানমন্ত্রীর কথা শুনে মনে হয় বিরোধী দলের কাজ হচ্ছে সরকারি দলকে সমর্থন করা। এই একই মানসিকতা থেকেই বঙ্গবন্ধু একদলীয় শাসনব্যবস্থা বাকশাল চালু করেছিলেন। বর্তমান আওয়ামী লীগ এখন আর বঙ্গবন্ধুর একদলীয় শাসন আদর্শে বিশ্বাস করে না।
প্রস্তাবিত বাজেটকে সরকারি দল ছাড়া কেউই সমর্থন করেননি। এমনকি সরকার সমর্থক বা আওয়ামী ঘরানার অর্থনীতিবিদেরাও এই বাজেটকে সমর্থন করেননি। ১/১১-এর কেয়ারটেকার সরকারের দুই নেতা জেনারেল মইন আর ফখরুদ্দীন (যারা নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন) ছাড়া বাকি সবাই নামের সাথে তকমা লাগিয়ে চার দিকে ঘুরে বেড়াচ্ছেন এবং নানা বিষয়ে দেশবাসীকে পরামর্শ দিচ্ছেন। তেমনি একজন মানুষ হচ্ছেন মির্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি নিয়মিত সেমিনারে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াচ্ছেন। এসব ভদ্রলোকই ওই সময়ে দেশের বিরাট তি করেছেন। জনসাধারণ তাদের কথা ভুলে গেছেন। তারাও বেহায়ার মতো কথা বলে চলেছেন। কই একজনও তো এ কথা বলেননি যে, সে সময়ে তারা বাধ্য হয়ে মন্দ কাজগুলো করেছেন বা মন্দ কাজের জন্য জাতির কাছে মাও চাননি। মির্জ্জা আজিজও বলেছেন, বিগত বছরের প্রায় সব ইকোনমিক ইন্ডিকেটরই নেগেটিভ। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমেছে, ডলার এক্সচেঞ্জ রেটও ১১ ভাগ কমেছে। প্রায় সব েেত্রই প্রবৃদ্ধি ও অগ্রগতি পেছন দিকে ছুটছে। তবুও আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলে চলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকার অনেক কাজ করেছেন যা সাংবাদিক ও বিরোধী দল দেখতে পায় না। সরকারি হিসাব এবং পরিসংখ্যানই বলেছে প্রবৃদ্ধি অনেক েেত্র নেগেটিভ। মির্জা সাহেব তার লেখায় বিষয়টা বিস্তারিতভাবে খোলাসা করেছেন। সিপিডিসহ আরো অনেক সংগঠন বলেছে বাজেট অবাস্তব। প্রধানমন্ত্রী তো বলেছেন তার ভালো কাজগুলো বিরোধী দল নষ্ট করে দেয়। তিনি গাছ লাগালে বিরোধী দল ফল খায়। আমি আমার লেখায় বহুবার বলেছি, কোনো রাজনৈতিক সরকার মতায় না থাকলেও প্রবৃদ্ধি হয়। প্রশ্ন তা কী রকম প্রবৃদ্ধি? বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হওয়া দরকার গড়ে ১০ শতাংশ। কিন্তু কোনো সরকারই এ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারেনি। যখন অরাজনৈতিক সরকার মতায় থাকে তখনো প্রবৃদ্ধি ৪-৫ শতাংশ হয়। এর মানে হচ্ছে সরকারি উদ্যোগ না থাকলেও জনগণের চেষ্টায় অর্থনীতির চাকা চলতে থাকে। ফলে কিছুটা প্রবৃদ্ধি একেবারে থেমে যায় না। ক’দিন আগে সৈয়দ আশরাফ বলেছেন আওয়ামী লীগকে আরো দুইবার নির্বাচিত করার জন্য। তাহলে তারা বাংলাদেশকে মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের মতো করে দেবেন। সৈয়দ সাহেবকে বলব, আপনি একজন মাহাথির ও একজন লি কুয়াং এনে দিন। বলুন বাংলাদেশে লি কুয়াং বা মাহাথির কে? বঙ্গবন্ধু এ কাজটি হয়তো পারতেন। বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য তিনি পারেননি। তিনি নিজেই বলেছেন, তার চার দিকে চাটার দল। তিনি বিদেশ থেকে যা আনেন চাটার দল সব খেয়ে ফেলে। তিনি আরো বলেছেন, সাত কোটি কম্বল রিলিফ এসেছিল কিন্তু তিনি তো পাননি। তাহলে তার ভাগেরটা কোথায় গেল? আমি নিশ্চিতভাবেই বলব, তার স্বপ্ন ছিল সোনার বাংলা গড়ার, কিন্তু অ্যাবিলিটি ছিল না। ফলে তার আমলেই দেশে দুর্ভি হয়েছিল এবং লাখ লাখ মানুষ না খেয়ে মারা গেছে। সে সময়ে গরিবের খাদ্য লুট করে বহু মানুষ ধনী হয়েছে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায়। তিনি দেশ ও দেশের মানুষকে ভালোবাসতেন এ ব্যাপারে কারো কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়। কিন্তু একজন প্রেমিক কখনোই উত্তম শাসক হতে পারেন না। বঙ্গবন্ধুকে পা ধরে সালাম করেই অনেকের কপাল খুলে গেছে। তিনি ভেবেছিলেন একদলীয় গণতন্ত্র চালু করলেই তিনি জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তন করতে পারবেন। এর মানে তিনি তখন সমালোচনা সহ্য করতে পারছিলেন না। তিনি না বুঝেই সমাজতন্ত্র চালু করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি নিজে যা ভালো মনে করেছিলেন তাই করেছেন। তিনি খবরের কাগজ বন্ধ করেছিলেন। তিনি সরকারি কর্মচারীদের রাজনীতিতে জড়িত করেছিলেন। তিনি যখন সমাজতন্ত্র চালু করার চেষ্টা করেছিলেন তখন সমাজতন্ত্রের মরণদশা। এখন তো চীন, রাশিয়াতেই সমাজতন্ত্র নেই।
গত ৪০ বছরে রাজনৈতিক নেতা ও তাদের বন্ধুরাই বিত্তবান হয়েছেন বাংলাদেশে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, দেশের মানুষের ক্রয়মতা বেড়েছে। কথাটা সত্যি। ’৭০ সালে যার দুই টাকা দিনমজুরি ছিল সে পাচ্ছে তিন শ’ থেকে চার শ’ টাকা। পরিবারের সদস্য সংখ্যা পাঁচ-ছয়জন। বৃদ্ধ মা-বাপ থাকলে তাদেরও দেখতে হয়। গরিবের বস্তি ভাড়া এখন দুই থেকে চার হাজার টাকা। বস্তির জায়গাগুলো বেশির ভাগই সরকারের। রাজনৈতিক মাস্তানরাই সব জায়গা ভাড়া দিয়ে খায়। দলগুলো মিছিলের জন্য এখান থেকেই লোক সংগ্রহ করে। ফুটপাথ, রেলস্টেশন, বাসস্ট্যান্ড, লঞ্চঘাটসহ বহু খালি জায়গায় মানুষ থাকে। রাজধানীতে নাকি এখন ৫০ লাখ মানুষ এসব এলাকায় থাকে। প্রতি বছর চার থেকে পাঁচ লাখ লোক রাজধানীতে আসে। গ্রামেও একই অবস্থা। দশ থেকে বারো কোটি লোক গ্রামে থাকে। এর ভেতর রয়েছে কৃষিশ্রমিক, হাটবাজারের দিনমজুর, ভিুক, ুদ্র ব্যবসায়ী। এদের সবারই নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। এরা ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাতে পারে না। ফলে তাদের জীবন থেকে অশিা দারিদ্র্য আর কখনোই যায় না। একটা জাতির সব মানুষকে নিররতা ও দারিদ্র্যমুক্ত করতে ৬৪ বছর লাগার কথা নয়। দেশের জনসাধারণ বিশেষ করে গরিব দিনমজুর ও নিম্নমধ্যবিত্তদের অবশ্যই বুঝতে হবে রাজনীতি, সরকারব্যবস্থা ও রাষ্ট্রীয় দর্শনে কোথাও বিরাট গলদ রয়ে গেছে। রাজনীতিবিদ, সংসদ সদস্য, আমলা, সরকার ও রাষ্ট্রের বন্ধুদের সবার বাড়ি-গাড়ি, ধনসম্পদ আছে এবং তা দিন দিন বেড়েই চলেছে। ধনীরা সচিব, জেনারেল, মন্ত্রী, সংসদ সদস্যদের সাথে আত্মীয়তা করেন। এমনকি আওয়ামী নেতাদের সাথে জামায়াত, মুসলিম লীগ ও বিএনপি নেতাদের আত্মীয়তা আছে এবং নতুন করেও হচ্ছে।
শুরুতেই বলেছি, বাজেটের বর্তমান দর্শন ও ব্যবস্থাপনায় এ দেশের গরিবের ভাগ্য পরিবর্তন হবে না। কারণ এ বাজেট সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য তৈরি করা হয় না। সোজা কথায় বলা যেতে পারে, এ বাজেট সাধারণ মানুষের জন্য নয়। এই তো ক’দিন আগেই আমরা সবাই দেখলাম, প্রাইমারি স্কুলের শিকেরা পুলিশের হাতে কিভাবে লাঞ্ছিত হয়েছেন। জলকামান দিয়ে তাদের শায়েস্তা করা হয়েছে। প্রাইমারি স্কুলের শিকেরা আর ক’ টাকাই বা বেতন পান। তাদের কাছে লেখাপড়া করেই তো সবাই প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, সচিব, বিচারপতি, জেনারেল হন। সবার জন্য বাজেটে বিরাট বিরাট বরাদ্দ। শুধু প্রয়োজনীয় বরাদ্দ নেই শিকদের জন্য। জনপ্রতিনিধির নামে মন্ত্রী-এমপিরা শুল্কমুক্ত দামি গাড়ি পান, সরকারি দামে দামি জমি পান। হয়তো তাদের অনেকেরই শিকদের মতো লেখাপড়াই নেই। বাজেটে কৃষি, বাসস্থান ও চিকিৎসার জন্য তেমন বরাদ্দ নেই। সরকার ও রাষ্ট্রের সাথে যাদের সম্পর্ক আছে তাদের সবার জন্যই বরাদ্দ আছে। আমার প্রশ্ন হলো, এ অঞ্চলের বাঙালি বা মুসলমান বাঙালিরা কেন স্বাধীন হয়েছে ৪০ বছর আগে। ৪০ বছর ধরেই সর্বহারা থাকার জন্য? তাদের চিকিৎসা, বাসস্থান, খাদ্য, বস্ত্র কিছুই তো হয়নি ৪০ বছরে। তাদের ছেলেমেয়েরা অল্পস্বল্প লেখাপড়া করলেও চাকরি পায় না।
আরেকটি কথা আমি অবশ্যই বলব, ভাগ্যের দোহাই দিয়ে গরিব মানুষদের আর ধোঁকা দেবেন না। চোর ডাকাত আর বদমায়েশদের ভ্যগ্যের পরিবর্তন হবে সাধারণ মানুষের হবে না এমন সমাজ নিশ্চয়ই আমরা প্রত্যাখ্যান করি। এমন সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা শত বছরেও গরিবদের ভাগ্যের পরিবর্তন করতে পারবে না। বর্তমান শোষণমুখী রাষ্ট্রব্যবস্থায় সাধারণ মানুষের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হবে না। সত্যি কথা বলতে কী, বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থা অকল্যাণকর এক ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। 
লেখক : কবি ও সাংবাদিক
ershadmz40@yahoo.com

বৃহস্পতিবার, ১৪ জুন, ২০১২

আবাসন খাতে ভারতীয় বিনিয়োগ


॥ এরশাদ মজুমদার ॥


জেনারেল মইন ও সাবেক আমলা ফখরুদ্দীনের তথাকথিত কেয়ারটেকার সরকারের আমল থেকে বিগত ছয় বছর ধরে আবাসন শিল্পে মন্দা বিরাজ করছে। এই শিল্পের উদ্যোক্তাদের বড় আশা ছিল রাজনৈতিক সরকার এলে মন্দা ভাব কিছুটা হলেও কেটে যাবে। বড়ই দুঃখের বিষয়, সেই মন্দা এখনো জারি রয়েছে। অপর দিকে রাজনৈতিক কারণে আবাসন শিল্পের সংগঠন রিহ্যাবেরও এখন খুবই দুরবস্থা যাচ্ছে। সেখানে নির্বাচন হচ্ছে না কয়েক বছর ধরে। এক সরকারি এমপি সভাপতি হয়ে বসে আছেন। ফলে রিহ্যাবের কার্যক্রম এক ধরনের স্থবির হয়ে আছে। রিহ্যাবের মর্যাদা এখন আর আগের মতো নেই। সদস্যদের ভেতর নানা গ্রুপ। ঠিক এমনি এক সময়ে ভারতের সাহারা গ্রুপ এসেছে বাংলাদেশে আবাসন খাতে বিনিয়োগ করতে। হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে, সাহারা বাংলাদেশে হঠাৎ করে আসেনি। পর্দার পেছনে সাহারার আগমনকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য প্রস্তুতি চলছিল। দিনণ এবং লেনদেন সব ঠিকঠাক করেই সাহারা বাংলাদেশে এসেছে। সাহারার আগমনকে হিন্দুস্তানি ভাষায় ধামাকা বলা হয়। এসেই মনে হলো ভিনি ভিসি ভিডি। মানেÑ আসলাম দেখলাম আর জয় করলাম। প্রতিমন্ত্রীর কোলাকুলির দৃশ্য আমরা টিভিতে দেখেছি। আহা সে কী আনন্দের দৃশ্য! না বলা কথা ছিল, ভাই, এত দিন পরে কেন এলে। আমরা তো বসেই আছি তোমাদের আগমনের জন্য। সেই যে পাকিস্তানি জেনারেলকে পরাজিত করে আমাদের রাজা বানালে, তারপর তো দেখতে এলে না। এত দিন তো অনেক কিছুই নিয়েছ, শুধু বাকি ছিল আমার দেশের মাটি। তুমি তো বলেছ ভাই, মায়ের কাছে এ দেশের অনেক গল্প শুনেছ বাল্যকালে। এখানে তোমার বাড়ি। তাহলে তো তোমার হক আছে আলবত। কোম্পানির নাম দিয়েছ মাতৃভূমি। আহা, কী আবেগি নাম! দেশপ্রেম না থাকলে অমন নাম কেউ রাখে কি? সবচেয়ে ভালো কাজ করেছ আমাদের প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয়স্বজনকে দিয়ে কাজটা করাচ্ছ। ব্যবসায়ীদের নাকি এ রকমই নিয়ম। যার কাছে মতা আছে তার সাথে হাত মেলাও। তাহলে ব্যবসায়ের কাজটা খুবই স্মুথ ও সোজা হয়ে যায়। সে দিক থেকে সাহারা ভাই তুমি সঠিক পথে আছো। আর একেবারেই সঠিক সময়ে এসে গেছ। তোমাদের পুরনো ভিটেমাটি ফেরত দেয়ার জন্য আমাদের প্রিয় প্রধানমন্ত্রী এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
ইতোমধ্যে খবরের কাগজে প্রকাশিত হয়েছে, শোভা বাজারের মহারাজার নাকি বিক্রমপুরে এক লাখ একর জমি পড়ে আছে। এটা জমিদারির জায়গা, না খাসজমি তা আমরা এখনো জানতে পারিনি। সাহারা ভাইয়েরও নাকি মাত্র এক লাখ একর জমির দরকার। ১৬০৮ বা ১০ সালে জব চার্নক গরিব চাষিদের কাছ থেকে কোলকাতা, গোবিন্দপুর ও সুতানুটি নামের তিনটি গ্রাম কিনে শহরের পত্তন করেছিলেন। সেই শহরই কোলকাতা শহর নামে পরিচিত হয়েছে। আমাদের কবিগুরুর বাপ-দাদারাও কোলকাতা শহরে গিয়ে জজমানি শুরু করেছিলেন। সেখান থেকেই তারা ঠাকুর বলে পরিচিতি পান। আসলে ছিলেন কুশারী। নয়া ঠাকুরদের কপাল ভালো, ১৭৫৭ সালে ইংরেজরা বাংলা দখল করে নিজেদের রাজত্ব শুরু করেছিলেন। আর যায় কোথায়? নয়া ঠাকুরদের কপাল খুলে গেল। কাশিমবাজার কুঠিতে ইংরেজরা যাদের সাথে রেখে ষড়যন্ত্র শুরু করেছিল, তাদের একজন ছিলেন শোভা বাজারের জমিদার। ১৯০ বছর শোষণের পরও ইংরেজরা আমাদের নমস্ব। তাহলে ইংরেজের খয়ের খাঁ শোভা বাজারের জমিদার বংশও নমস্ব হবেন না কেনো?
দেশের বড় বড় অর্থনীতিবিদ বলেছেন, সাহারা গ্রুপ আবাসন ছাড়া অন্য খাতে, যেমন বিদ্যুৎ, অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ করছে না কেন? আবাসন খাতে তো আমাদের বড় বড় ডেভেলপার আছেন। তারা তো সংবাদ সম্মেলন করেই বলেছেন, সুযোগ পেলে তারাও বড় বড় স্যাটেলাইট শহর বানাতে পারবেন। স্থানীয় ডেভেলপাররা হক-হালালি কথা বলেছেন। দৈনিক মানবজমিন ইতোমধ্যে সাহারা গ্রুপ সম্পর্কে বড় একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, ভারতে সাহারা গ্রুপের ইমেজ মোটেই ভালো নয়। যেখানে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে সরকার প্রায় বছরখানেক ধরে নানা অসুবিধায় আছে, সেখানে সাহারা গ্রুপকে ওই সেতুর জন্য বিনিয়োগ করতে আহ্বান না করে আবাসন খাতে বিনিয়োগের আহ্বান জানানোর ব্যাপারটা রহস্যজনক। তাও আবার প্রধানমন্ত্রীর অতি নিকটাত্মীয়কে সাহারার পার্টনার করে। এই তো ক’দিন আগে দেখলাম, সাহারা গ্রুপ আমাদের ক্রিকেট বোর্ডকেও শত শত কোটি টাকা দিয়ে সাহায্য করবে। আসতে না আসতেই নানা দিকে চোখ পড়েছে সাহারার। ক’দিন পরে শুনব সাহারা মিডিয়াতেও বিনিয়োগ করবে এবং সেখানে স্লিপিং পার্টনার হবেন প্রধানমন্ত্রীর চোখের মণি। হঠাৎ করে সাহারাকে নিয়ে এমন হইচই কেন শুরু হয়েছে বুঝতে পারি না।
বাংলাদেশের অনেক আবাসন ব্যবসায়ী মিডিয়ায় পুঁজি বিনিয়োগ করে নিজেরাই নিজেদের কামড়াচ্ছেন। নিজেদের মালিকানার মিডিয়াগুলোকে প্রতিপকে ঘায়েল করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন। আবাসন ব্যবসায়ীদের এসব কাগজ বা টিভি চ্যানেলে অনেক নামীদামি সাংবাদিক কাজ করছেন এবং বিভিন্ন ফোরামে ফোরামে মালিকের পে বেশরম ওকালতি করছেন। দ্বিতীয়টি হলো পোশাক রফতানিকারকেরা আর তৃতীয়টি আবাসন শিল্পের মালিকেরা। এ তিনটি সেক্টরে অনিয়ম আর দুর্নীতি হয়েছে সবচেয়ে বেশি। তাই জেনারেল মইনের সরকারের আমলে সবচেয়ে বেশি বিপদ নেমে এসেছিল এদের ওপর। যদিও আমরা তা সমর্থন করিনি। কারণ ওই সময়ের হামলার ফলে অর্থনীতিতে স্থবিরতা নেমে এসেছিল। দুর্নীতি দমনের কথা বলে সেই সরকারের কর্তারা ব্যাপক দুর্নীতি করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বহু ব্যবসায়ী কোটি কোটি টাকা দিয়ে অত্যাচার থেকে রা পেয়েছে। জেনারেল মইনের সরকারের ভয়ে যারা দেশত্যাগ করেছিলেন, তারাই পরে একই মঞ্চে বসে লেনদেনের কথা বলেছেন।
আমার ছেলে আমাকে প্রশ্ন করেছে, বাবা তুমি কি বর্তমান অসাম্যতার বেনিফিসিয়ারি? উত্তরে আমি হ্যাঁ-সূচক জবাব দিয়েছিলাম। আমিও তো এই সমাজের একজন সুবিধাভোগী। বিগত ৬৪ বছরে আমাদের এই দেশে, আমাদের সমাজে অশিা, নিররতা, দারিদ্র্য আর শোষণ অত্যন্ত লজ্জাজনকভাবে চালু রয়েছে। মুক্তির আশা করে ১৯৭১ সালে আমরা পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করে বাংলাদেশ বানিয়েছি। স্বাধীন বাংলাদেশেরও ৪০ বছর পার হয়ে গেছে। কিন্তু বেশির ভাগ মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। ১৯৭০ সালে যে লোকটি ২০০ টাকার কেরানি ছিলেন সেই লোকটি এখন হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক। যে লোকটি ১৯৭০ সালে দুই টাকা রোজ মজুরি পেতেন তিনি এখন হয়তো ৩০০ টাকা পান। ১৯৭০ সালে এক কেজি চালের দাম ছিল ৫০ থেকে ৬০ পয়সা। আর এখন এক কেজি চালের দাম ৩০ থেকে ৭০ টাকা। যিনি ২০০ টাকা বেতন থেকে দুই হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন, তিনি খান ৭০ টাকা দামের চাল। হয়তো তিনি জানেনও না চালের কেজি কত? কিন্তু ৩০০ টাকার দিনমজুরকে জানতে হয়। ক’দিন আগে সোনাগাজীর কাশেমের সাথে দেখা হয়েছিল। তারা কয়েক জেনারেশন ধরে এক নামকরা বাড়িতে কাজ করে। কিন্তু ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন করতে পারেনি। কারণ লেখাপড়া শেখেনি। সমাজ তাদের লেখাপড়া শিখতে দেয়নি। কাশেমের মেয়ে এসএসসি পাস করেছে কিন্তু টাকার অভাবে কলেজে ভর্তি হতে পারছে না। বাড়তি আয়ের জন্য কাশেমের একটি চাকরি দরকার। অপর দিকে মেয়ের বিয়ে দিতে গেলেও যৌতুকের জন্য কাশেমের লাখখানেক টাকা লাগবে। আপনাদের একজন কাশেমের খবর দিলাম। বাংলাদেশের আরেকজন স্বাধীন নাগরিকের কথা বলছি। ইনি একজন মহাগরিব নিরর মহিলা। স্বামী তালাক দিয়ে চলে গেছেন। মহিলার দুই মেয়ে অন্যের বাড়িতে কাজ করে। আর মহিলা ভিা করেন। এই সমাজই ওই পরিবারটিকে শোষণ করছে। এটি চলছে বলেই আমি বাসার জন্য কাজের মেয়ে পাই অতি সস্তায়। রাস্তায় রিকশা, মুটে, শিশুশ্রমিক পাওয়া যায়। ওরা গরিব ও শক্তিহীন হওয়ার কারণেই বাংলাদেশে পোশাক শিল্প গড়ে উঠেছে। ওরা গরিব বলেই জনশক্তি ব্যবসায় রমরমা হয়ে উঠেছে।
শত চেষ্টা করেও আবাসন ব্যবসায় নিয়মনীতি প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। এ ব্যাপারে সরকারও উদাসীন। সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলগুলোও উদাসীন। রিহ্যাব ছাড়াও কয়েক হাজার কোম্পানি ফ্যাটের ব্যবসায় করছে। যেকোনো লোক যেকোনো সময় এ ব্যবসায় শুরু করতে পারে। এখন এ ব্যবসায় জেলা ও উপজেলা শহরে চলে গেছে। রাজধানীতে অভিজাত এলাকার জমির মালিকেরা কিছুটা বেনিফিট পাচ্ছেন। এসব এলাকায় জমির দামের কোনো ঠিকঠিকানা নেই। ক্রেতারা নাকি বলেন, জমি আছে কি না বলুন। দাম যা চাইবেন তাই পাবেন। তবে বিষয়টা গোপন রাখতে হবে। এসব এলাকার জমি আবার বিতরণ করে সরকার। কাঠা ১৫-২০ লাখ টাকা। কিন্তু বাজারদাম কাঠাপ্রতি কয়েক কোটি টাকা। এর মানে হচ্ছে, চেনাজানা মানুষকে রাতারাতি ধনবান করে দেয়া। আবাসন ব্যবসায়ীরাও ৫০ কোটি টাকার জমি পাঁচ কোটি টাকা নগদ দিয়ে পজেশন নিয়ে নেন আর বিজ্ঞাপন দিতে থাকেন। আর টাকা আসতে থাকে। দু-তিন বছর পরে ফ্যাটের ডেলিভারি পাবেন, এখন থেকেই মাসে লাখ লাখ টাকা কিস্তি দিতে থাকেন। একটি ফ্যাটের দাম দুই কোটি টাকা থেকে ১০ কোটি টাকা। এখানেই তো কালো টাকার বিষয়টি উঠে এসেছে। টাকার হিসাব চাইলে তো ফ্যাট ব্যবসায় হবে না, ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা যাবে না, বিনিয়োগ বাড়ানো যাবে না। তাই কালো টাকাকে কালো জায়গা থেকে সাদা জায়গায় নিয়ে আসতে হবে। তাই তো সাদা মনের মানুষ খুঁজতে গিয়ে একজন ধনী মানুষকেও পাওয়া যায়নি। সব সাদা মনের মানুষ সাদামাটা সাদাসিধে জীবন যাপন করেন। ধন তাদের ধারেকাছেও আসতে চায় না। রাষ্ট্র নিজেই কালো টাকার জন্ম দেয়। রাষ্ট্রের প্রিয় মানুষেরাই কালো টাকার মালিক হন। রাষ্ট্র চাওয়া মাত্রই আপনাকে ধনী বানিয়ে দিতে পারে। এখন প্রশ্ন হলো, ওই ধন কালো না সাদা? ১৯৭২ সাল থেকেই আমি কালো টাকার বিষয়ে লিখে আসছি। সাদাকালো শিরোনামে একটি নিয়মিত কলাম লিখতাম দৈনিক জনপদ-এ। আমাদের যে রাষ্ট্রব্যবস্থা, তাতে কালো টাকার জন্ম একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। যেমন বিয়ে না করে সন্তান জন্ম দেয়া একটি অবৈধ কাজ। ধর্ম ও আইনের চোখে একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। নারী-পুরুষের অবৈধ মিলন এ জগতের কোথাও থেমে নেই। কোন সমাজ এই অবৈধ কাজকে স্বীকৃতি দিয়ে বৈধতা দিয়েছে। তেমনি কালো টাকারও আইনি চোখে স্বীকৃতি নেই। কিন্তু রাষ্ট্র ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কারণে প্রতিনিয়তই কালো টাকার জন্ম হচ্ছে। যারা কালো টাকার মালিক হন তারা রাষ্ট্রের বন্ধু বা বন্ধুদের বন্ধু। যেমনÑ পুঁজি বিকাশের জন্য উদ্যোক্তাদের রাষ্ট্র নানা রকম সুযোগ দিয়ে থাকে। পূর্ব পাকিস্তানে পুঁজি বিকাশের কথা বলে ১৯৬০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা নানা ধরনের সুযোগ সুবিধা দাবি করে দেনদরবার করেছিলেন। সে সময় বেশ কিছু ২৫০ লুমের পাটকল স্থাপিত হয়েছিল। একই সময়ে ওজিএল বা ওপেন জেনারেল লাইসেন্সের কথা বলে বাঙালিদের পুঁজি গঠনের সুযোগ দেয়া হয়েছিল। বর্তমানে যে কালো টাকা লুকিয়ে আছে তা বিনা কর বা জরিমানায় সাদা করলে কয়েকটি পদ্মা সেতু হতে পারে। কালো টাকার জন্ম হয় চলমান রাজস্বব্যবস্থার কারণে। একটু আগেই বলেছি, রাজউকের প্লট ২০ লাখ টাকায় যখন কাঠা বিক্রি হয় তখন এর বাজারদর তিন কোটি টাকা। এই প্লটগুলো পান রাষ্ট্রের বন্ধুরা। এই প্লট যখন কেউ বিক্রি করেন তখন কি দলিলে তিন কোটি টাকা দেখান? না, দেখান না। এভাবে জমি বেচাকেনার সময়ও দলিলে আসল দাম উল্লেখ করা হয় না। প্রতিদিনই কালো টাকার জন্ম হচ্ছে, আর একে সাদা করার জন্য সরকারের ওপর চাপ থাকবে। কালো টাকা সবচেয়ে বেশি থাকে ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, রাজনীতিক, আমলা ও সরকারি কর্মচারীদের কাছে। এবার রাজনৈতিক কারণে যে ব্যাংকের অনুমতি দেয়া হয়েছে, তাতে লোকজন পরিচালক হচ্ছে ১০০ কোটি টাকা দিয়ে। কিন্তু কাগজ-কলমে দেখাচ্ছে ১০ কোটি টাকা। যিনি রাজনৈতিক কারণে অনুমতি পেয়েছেন তার কোনো পুঁজি লাগবে না। তিনি হবেন ব্যাংকের চেয়ারম্যান। শুধু অনুমতির তদবির করার জন্যই তিনি পাবেন হয়তো চার-পাঁচ শ’ কোটি টাকা। অথচ এই টাকা তিনি জীবনেও দেখেননি।
আবাসন ও চিকিৎসা খাতেও কালো টাকার ছড়াছড়ি। রাতারাতি ধনী হওয়ার জন্য সবচেয়ে বড় খাত। ২০ বছর আগে অজানা অচেনা এক ডায়াগনস্টিক সেন্টার খুলে এখন হাসপাতাল, মেডিক্যাল কলেজ, ওষুধ কোম্পানি, রিয়েল এস্টেটের মালিক। যেখানেই ব্যবসায়ের দ্রুত বিকাশ হয়েছে সেখানেই কালো জন্ম হয়েছে। অনেকে বলেন, আমরা তো টাকা বিদেশে নিয়ে যাইনি; দেশেই বিনিয়োগ করেছি। হাজার হাজার লোক কাজ করে। আমাদের ধনীদের ৮০ ভাগই বিদেশে বাড়ি কিনেছেন। কিন্তু দেশ থেকে কোনো টাকা বিদেশে নিয়ে যাননি। অনেক রাজনীতিকও বিদেশে বাড়ি কিনেছেন। এসব তো কালো টাকারই অবদান। ধনীদের আরেকটি বড় কাজ হচ্ছে, ছেলেমেয়েদের বিয়েতে দরাজদিলে কালো টাকার ব্যবহার করা। মুম্বাই সিনেমা দেখে দেখে বিয়ের অনুষ্ঠান তৈরি করা হয়। দাওয়াতের কার্ড থাকে ১৬-১৭টি। এসব বিয়েতে সমাজ ও রাষ্ট্রের নামীদামি তারকারা উপস্থিত থাকেন। এমনকি কোনো কোনো অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীরাও থাকেন।
ভারতের সাহারা গ্রুপ তেমনি একটি নামজাদা কালো টাকার মালিক। সেই টাকা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করার জন্যই সাহারা বাংলাদেশে আসছে। হয়তো তাকে টাকাও আনতে হবে না। স্থানীয় সহযোগীরাই হয়তো কালো টাকার জোগান দেবে। যেমন করে জগৎশেঠ কাইভকে টাকার জোগান দিয়েছিল। এমনও হতে পারে সরকার বলবে যত টাকা আনো কোনো কর বা শুল্ক দিতে হবে না। আবাসন খাতে বিদেশী বিনিয়োগ অল্পস্বল্প এখনো আসছে। কিন্তু তারা সরকারের আনুকূল্য পাচ্ছে না। হয়তো রাজউক বা সরকার এ ব্যাপারে কিছুই জানে না। বাংলাদেশে সাহারা আসার ব্যাপারে হয়তো কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে। এটা আবাসন খাতে বিনিয়োগ, না রাজনীতি তা এখনো স্পষ্ট নয়। অনেকেই বলছেন, সাহারার বিনিয়োগের বিষয়টি এখনো খোলাসা হয়নি। সাহারা কী বিনিয়োগ করবে? কত টাকা বিনিয়োগ করবে দেশবাসী তা জানে না। রাজউক কী চুক্তি করেছে তাও প্রকাশ করা হয়নি। রাজউক যদি সাহারাকে জমি দখল করে দেয় তাহলে দেশী বিনিয়োগকারীদের সেই সুযোগ দেবে না কেন? সরকারই বা এ ব্যাপারে এত রাখঢাক করছে কেন? 
লেখক : কবি ও সাংবাদিক
ershadmz40@yahoo.com

শুক্রবার, ৮ জুন, ২০১২

রাজনীতির মতা আর মতার রাজনীতি


॥ এরশাদ মজুমদার ॥


রাজা-বাদশাহদের যুগ পেরিয়ে আমরা আধুনিক যুগে এসেছি বলে ঢোল পিটিয়ে দেশে-বিদেশে সবাই বলছেন। একসময়ে রাজারা দিগ্বিজয়ে বের হতেন। জোর করে অন্যের দেশ দখল করতেন, আর বাহবা পেতেন। আমরা আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের নাম জানি। তিনি গ্রিসের মেসিডোনিয়া থেকে দেশ জয় করতে করতে ভারতবর্ষের উত্তরে এসেছিলেন। সে কথা আমরা জানি পুরুর সাথে তার যুদ্ধের গল্প থেকে। পরাজিত পুরুকে নাকি আলেকজান্ডার জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনি আমার কাছে কী ধরনের ব্যবহার আশা করেন। পুরু নাকি বলেছিলেন, রাজার কাছে রাজা যেমন ব্যবহার পেতে পারেন, সে রকম। পুরুর কথা শুনে আমরা খুব খুশি। হেরে গেলেও আমাদের রাজার সাহস আছে। সে সময়ে ভারতীয়রা এ ধরনের বহুবার বহু জায়গায় হেরেছে আর বিদেশীদের জয়গান গেয়েছে। এই তো দেখুন না, রাম বলে কেউ নেইÑ এ কথা বহুবার বলা হয়েছে। স্বয়ং কবিগুরু বলেছেন, রামের জন্ম কবির মনোভূমিতে। কিন্তু কে কার কথা শোনে। কবি কল্পনা করে রামায়ণ নামের মহাকাব্য লিখেছেন। সেই কাব্যই এখন প্রায় ধর্মগ্রন্থে পরিণত হয়েছে। বিদেশী রাজার এমন বিজয়গাথা জগতে কেউ কখনো দেখেছে কি না জানি না। শেষ পর্যন্ত বিদেশী বিজয়ী রাজাকে অবতার ও দেবতা বানানো হয়েছে। আর দেশী পরাজিত রাজা রাবণকে বানানো হয়েছে রাস। তেমনি বিদেশী দখলদার ইংরেজদের আমরা আজো স্মরণীয়-বরণীয় মনে করি। আজো আমরা কমনওয়েলথের সদস্য। এর অর্থ একদিন আমরা তাদের দখলে ছিলাম এবং তাদের প্রজা ছিলাম, সে কথা আমরা জোর গলায় জাহির করছি। এখনো আমাদের দেশের লোক স্যার টাইটেল পেলে খুশিতে আটখানা হয়ে যান। দেশী ভাইবেরাদরের সহযোগিতায় ইংরেজরা এই দেশটাকে ১৯০ বছর শাসন ও শোষণ করেছে। কী ধরনের শোষণ করেছে তা এখন আমাদের বন্ধুবান্ধব ও নতুন প্রজন্মের 
সন্তানেরা হয়তো ভুলে গেছে। আমাদের নতুন প্রজন্মের সন্তানেরা ইতিহাস নিয়ে তেমন মাথা ঘামায় না। তারা আজ নিয়ে ভাবে। গতকাল নিয়ে ভাবে না। হয়তো এমন অনেক তরুণ আছে, যারা ভালো করে দাদার নামও জানে না। হয়তো ওই নামটা তার কখনো প্রয়োজন হয়নি। হয়তো দাদা একেবারেই নগণ্য একজন মানুষ ছিলেন। তাই বাপ তার নিজের বাপের পরিচয় দিতে লজ্জা পেতেন। হয়তো বা ধনী হয়ে নিজের অতীতকে মুছে দিয়েছেন। এমন তরুণ বা তাদের বাবাদের ইতিহাস না জানলেও চলে। এ কারণেই আমাদের ইতিহাস নিয়ে এত কথা। প্রায় সবাই বলছেন, ইতিহাস বিকৃতি হচ্ছে। কোনটা সত্য ইতিহাস তা নিয়ে আমরা বিভ্রান্ত। যে দল যখন মতায় আসে, সে দল নিজের মতো করে ইতিহাস বলে। একদল বলে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। যদিও আমরা কেউ তার ঘোষণা শুনিনি। আদালত বলেছেন, বঙ্গবন্ধুই ঘোষণা দিয়েছেন। তাই এ নিয়ে আর কোনো কথা চলবে না। হাজার হলেও আদালতের ফরমান। ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধুর ইতিহাস নিয়ে প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদ বেকায়দায় পড়েছেন। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী হুমায়ূনকে লেখা বদলাতে হবে। এত দিন হুমায়ূন বানিয়ে বানিয়ে গল্প লিখতেন। কিন্তু ইতিহাস নিয়ে লিখতে গিয়েই ধরা পড়ে গেলেন।
জাতি হিসেবে আমাদের বায়া দলিল অর্থাৎ ইতিহাস আজো বিতর্কিত। কোনটা সঠিক, তা আজ আর বোঝা যায় না। আমি প্রায়ই বলি, জমির যদি বায়া দলিল থাকে, বংশের যদি বায়া দলিল থাকে, তাহলে দেশের বায়া দলিল থাকবে না কেন? আমরা তো আজো সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি, আমরা কি শুধুই বাঙালি, না বাঙালি মুসলমান। বিশ্ববাঙালি নামে এখন নতুন স্লোগান শুনতে পাচ্ছি। বিদেশের মাটিতে বিশ্ববাঙালি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সারা বিশ্বের বাঙালিরা উপস্থিত হন। এই সম্মেলনে যারা উপস্থিত হন, তাদের মধ্যে শুধু বাংলাদেশীদেরই একটি স্বাধীন রাষ্ট্র আছে, বাকি বাঙালিদের কোনো রাষ্ট্র নেই। পৃথিবীর ৩০ কোটি বাঙালির মধ্যে ১৫ কোটি বাঙালির কোনো স্বাধীন রাষ্ট্র বা দেশ নেই। পরাধীন বাঙালিরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাস করেন ও কাজ করেন। বিদেশি যারা বাস করেন তারা কেউ ভারতীয়, কেউ ব্রিটিশ বা কেউ অন্য কোনো দেশের। বাঙালি হলেও সবাই বাংলাদেশী নন। এমনকি আমাদের উপজাতিরাও নিজেদের বাঙালি মনে করেন না। জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধু যখন আহ্বান জানালেন, তোরা পাহাড়িরা সবাই বাঙালি হয়ে যা। তখন মানবেন্দ্র লারমা প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিলেন, আমরা বাঙালি নই। আমরা বাংলাদেশী।
রাজনীতির প্রধানতম উদ্দেশ্যই নাকি মতায় যাওয়া। কারণ, মতায় না গেলে আদর্শ বা উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করা যায় না। তাই মতায় যাওয়ার জন্য রাজনীতির প্রয়োজন। দল ছোট হোক বা বড় হোক, রাজনীতি করলে একদিন মতায় যাওয়া যাবেই। তার প্রমাণ মতাসীন মহাজোট। শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া মন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন কোনো দিনও দেখেননি। ভোট করে তিন-চার শ’র বেশি ভোট পান না। ভগবান বুদ্ধ বড়ুয়ার দিকে মুখ তুলে চেয়েছেন। তাই দিলীপ বড়ুয়া আজ মন্ত্রী। মেনন ও ইনুরও একই অবস্থা। মতায় যাওয়ার জন্য কৌশলগত কারণে নিজের মার্কা ত্যাগ করে নৌকা মার্কায় নির্বাচন করেছেন। ২০০৮ সালের ওই নির্বাচনে জয়লাভ ছিল ১০০ ভাগ গ্যারান্টেড। মেনন একবার জিয়ার আমলে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। ইনুর সে সুযোগও হয়নি। জীবনে একবারো এমপি বা সংসদ সদস্য হননি এমন অজানা-অচেনা লোকেরাও মন্ত্রী হয়েছেন। উর্দুতে একটা কথা আছেÑ ‘খোদা মেহেরবান তো, গাধা ভি পাহলোয়ান।’ শেখ হাসিনা যার ওপর খুশি হয়েছেন তিনিই মন্ত্রী হয়ে গেছেন। নির্বাচন না করেও মন্ত্রী হয়েছেন। নির্বাচনে যারা শলা দিয়েছিলেন জেতার জন্য তারাও আজ মন্ত্রীর পদমর্যাদায় উপদেষ্টা। লোকে বলে উপদেষ্টাদের মতা নাকি মন্ত্রীদের চেয়ে হাজার গুণ বেশি। শেখ হাসিনার মতা আছে তাই তিনি নিকট-দূর বহু আত্মীয়স্বজনকে পাহলোয়ান বানিয়ে দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর আমলেও তার আত্মীয়স্বজনেরা মতার স্বাদ পেয়েছিলেন। শুনেছি, গণচীনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইকে বিদেশী সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করেছিলেন, আপনার জীবনে সাফল্যের প্রধান কারণ কী? চৌ উত্তরে বলেছিলেন, আমি আত্মীয়দের সব সময় দূরে রেখেছি। শহীদ জিয়ার েেত্রও তাই শুনেছি। জিয়া নাকি আত্মীয়স্বজনদের কখনোই কাছে ঘেঁষতে দেননি। শেরে বাংলা অখণ্ড বঙ্গদেশের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে নিজের এক অযোগ্য ভাগিনাকে চাকরি দিয়েছিলেন। সংসদে এ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, প্রার্থীর যোগ্যতা সে প্রধানমন্ত্রীর ভাগিনা। বঙ্গবন্ধুর ভাগিনারাও তার মতায় থাকাকালে নানা ধরনের সুযোগ পেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতিকেও নাকি তিনি রাতারাতি সচিব বানিয়ে দিয়েছিলেন। নাম নাজানা বেয়াই সাহেবও মন্ত্রী হয়েছেন। মতা থাকলে বা মতায় থাকলে মতাবানেরা নিজের নামে এবং আত্মীয়স্বজনের নামে অনেক কিছু করেন। টাকা কিন্তু জনগণের, জনগণের নামে বিদেশ থেকে ধার করে আনা অথবা জনগণের কাছে আদায় করা টাকা। পাকিস্তান আমলে অনেক নাম বদলে গেছে। বাংলাদেশ আমলে সেসব আবার বদলেছে। যেমন ধরুন, ইংরেজ আমলে ব্যবসায় ছিল হিন্দুর, পাকিস্তান আমলে সেটা হয়েছে অবাঙালি মুসলমানের। বাংলাদেশ হওয়ার পর সেই ব্যবসায় হয়ে গেল বাঙালি আওয়ামী মুসলমানদের। মতার ধারা এমনিই চলে। আপনার মতা থাকলেই হলো। আইনের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত মতা, না হয় দলের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত মতা। রাজনীতি করলেও আপনার এই মতা থাকতে পারে, আবার রাষ্ট্র আপনার হাতে বা পাশে থাকলেও হতে পারে।
রাজনীতি না করেও মতায় আসা যায়। যেমন সামরিক আইন জারি করে, দেশের সংবিধান বাতিল করে সেনাপ্রধান মতায় আসতে পারেন। সেখানে তার সমর্থক থাকবেন সৈনিকেরা, আর সেনা অফিসারেরা। পাকিস্তান আমল থেকে আমাদের দেশে বহুবার সামরিক শাসন জারি হয়েছে। সেনাপ্রধানেরা মতায় এসে রাষ্ট্রপ্রধান, প্রেসিডেন্ট বা রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর ইন্তেকালের (স্থান পরিবর্তন) পর সামরিক শাসন জারি করে তারই বন্ধু খোন্দকার মোশতাক মতায় আসেন। তাকে সমর্থন দিয়েছে সেনাবাহিনী ও আওয়ামী লীগের একাংশ। পরে সেই মতা হাতবদল হয়ে চলে যায় সে সময়ের সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়ার কাছে। এর মধ্যে একমাত্র জেনারেল জিয়াই ছিলেন জনপ্রিয় শাসক। সেটা প্রমাণিত হয়েছে তার জানাজায় লাখো মানুষের অংশগ্রহণে। এ দেশে কারো জানাজায় এত মানুষের সমাগম হয়নি। জেনারেল জিয়াকে যারা দেখতে পারেন না, তাদের মত অবশ্য ভিন্ন। সামরিক আইন নিয়ে জাস্টিস মুনিমের একটি বই আছে। এটা ছিল তার পিএইচডি থিসিস। জেনারেল আইউবের সামরিক আইন জারি নিয়ে লিখতে গিয়ে তিনি সামরিক আইনের ইতিহাস বর্ণনা করেছেন। ইংল্যান্ডে প্রথম রাজারা এই আইন ব্যবহার করেন। তবে বলা হয়েছে, এটা কোনো আইন নয়। যুদ্ধের সময়েই শুধু এ আইন ব্যবহার করা যেতে পারে, 
শান্তির সময় নয়। জেনারেল আইউব যখন সামরিক আইন জারি করে মতা দখল করেছিলেন, তখন কোনো যুদ্ধাবস্থা ছিল না। এই তো কিছু দিন আগে জেনারেল মইন দেশে জরুরি অবস্থা জারি করতে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রফেসর ইয়াজউদ্দিনকে বাধ্য করেন। জেনারেল মইন একটা সিভিল সরকার নিয়োগ করে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সারা দেশে সেনা অফিসাররা প্রশাসন চালানোর দায়িত্ব নেন। দুর্নীতির মূলোচ্ছেদ করার নামে দেশের অর্থনীতিকে তছনছ করে ফেলেন। দেশের মানুষ মনে করে, জরুরি অবস্থা জারি করার প্রেতি তৈরি করেছে গোয়েন্দা বাহিনী। আর আওয়ামী লীগ বিশৃঙ্খল অবস্থা সৃষ্টির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। অথবা বলা যেতে পারে, জেনারেল মইনের মতা গ্রহণকে আওয়ামী লীগ সমর্থন করেছে। আর এ জন্য পুরস্কার হচ্ছে ২০০৮ সালের নির্বাচন। একসময় বলা হতো, ‘মাইট ইজ রাইট’। জোর যার মুল্লুক তার। মাঝখানে মনে হয়েছিল, সেসব দিন বাসি হয়ে গেছে। না, এখনো সেসব দিন বাসি হয়নি। এখনো শক্তি থাকলে উপায় হয়। রাষ্ট্রশক্তি থাকলে তো কথাই নেই। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো একটি রাষ্ট্র যদি কারো দখলে থাকে, তাহলে তো আর কথাই নেই। যিনি মতায় থাকবেন বা মতা দখল করবেন, রাষ্ট্র তার কথামতো চলবে। কিন্তু বলা হবে, আইনের শাসন চলছে। আগেই বলেছি, আইন তো তৈরি হয়েছে যারা রাষ্ট্র চালাবেন তাদের স্বার্থ রার জন্য। এমন দেশে জনগণের নামে সব কিছু হবে, কিন্তু জনগণ থাকবে না।
জেনারেল আইউব গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠিয়ে, রাজনীতিকদের হেনস্তা করে প্রায় দশ বছর মতায় ছিলেন। পরে আন্দোলনের মুখে জেনারেল ইয়াহিয়ার কাছে মতা দিয়ে বিদায় নিয়েছিলেন। আর জেনারেল ইয়াহিয়া সাধারণ নির্বাচন দিয়েও পাকিস্তানকে রা করতে পারেননি। বাংলাদেশের জেনারেল এরশাদও গণরোষের মুখে পদত্যাগ করে জেলে গিয়েছিলেন। এখনো তার বিরুদ্ধে বহু মামলা রয়েছে। এরশাদ মতা দখল করে বলেছিলেন, তিনি দিল্লির সাথে কথা বলেছেন। আওয়ামী লীগও এরশাদকে সমর্থন করেছিল। ’৮৬ সালের নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ এরশাদের সাথে হাত মিলিয়েছিল। এখনো এরশাদ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের সাথে রয়েছেন। মূলত এরশাদের মতার উৎসস্থল হচ্ছে দিল্লি। দিল্লি বাংলাদেশে ছোট-বড় তিন-চারটি পলিটিক্যাল টিম রেখে রাজনীতির মাঠে খেলাধুলা করে। জেনারেল আইউব মতা দখল করে বেসিক ডেমোক্রেসি চালু করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু একদলীয় শাসন চালু করেছিলেন নিজের মতাকে পোক্ত করার জন্য। এখন শেখ হাসিনা বলছেন, তিনি জানেন কিভাবে বিরোধী দলকে সোজা পথে আনতে হয়। কোথায় যেন এক টুকরো খবর দেখলাম, প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় বলেছেন, আগামী ২৫ বছরে বাংলাদেশে হিন্দু প্রধানমন্ত্রী হয়ে প্রমাণ করবেন, বাংলাদেশ একটি মহান সেকুলার দেশ। দিল্লির উসকানিতে বাংলাদেশকে সেকুলার ভূতে পেয়েছে। আওয়ামী লীগ এ বিষয়টা গভীরভাবে অনুধাবন করতে পারছে না, দিল্লিকে তুষ্ট করার জন্য আওয়ামী লীগ মতায় এসেই নানা ধরনের মামলায় জড়িয়ে পড়েছে। প্রায় চার বছর পার করতে চলেছে বর্তমান সরকার শুধু মামলা নিয়েই নিজেদের ব্যস্ত রেখেছে। দেশের উন্নয়ন নিয়ে সরকারের কোনো মাথাব্যথা নেই। সরকারের সামনে দেশের মানুষ নেই, বিরোধী দল নেই। অবিষয়কে বিষয় বানিয়ে সরকার নিজেকে ব্যস্ত রেখেছে। যেমন ধরুনÑ গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. ইউনূস সমস্যা । কেন যে হঠাৎ গ্রামীণ ব্যাংক সরকারের জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে তা দেশবাসী বুঝতে পারছে না। শেখ হাসিনার একটি সুবিধা আছে, তা হলোÑ তিনি যা বলেন, তার পারিষদ বলেন তার হাজার গুণ বেশি। লোককথা হচ্ছেÑ এক শিয়ালে ডাক দিলে শত শিয়াল হুক্কা হুয়া শুরু করে। কোনো শিয়ালই কারণ-অকারণ জানতে চায় না। এটা অবশ্য দলের জন্য খুব ভালো। আমরা যারা ৫০ বছর ধরে আওয়ামী সংস্কৃতি ও ঘরানার রাজনীতি দেখে আসছি, ল করেছি যে, এখানে শক্তিই প্রধান দর্শন, যুক্তি বা জ্ঞান কখনোই কাজ করেনি।
দল হিসেবে আওয়ামী লীগের চরিত্র আর দেশ হিসেবে আমেরিকার চরিত্র প্রায় একই রকম। জোর করে আদর্শ প্রচার করা উভয়েরই সংস্কৃতি। আমেরিকার ৮০ শতাংশ মানুষই অতি সাধারণ, দেশের রাজনীতি বা রাজনীতিবিদদের নিয়ে তারা কখনোই চিন্তা করে না। তারা নিয়মিত সপ্তাহের মজুরি পেলেই খুশি। দেশ কারা চালায়, কিভাবে চালায় তা নিয়ে আমেরিকার সাধারণ মানুষের কোনো মাথাব্যথা নেই। ফলে দু’টি রাজনৈতিক দলের কিছু নেতা আর ধনীরা দেশটা চালায়। ফলে আমেরিকা সারা পৃথিবীকে অশান্ত করে রেখেছে। প্রতিনিয়ত সারা পৃথিবীর মানুষকে ধমকের ওপর রেখেছে। কথা শুনতে বিভিন্ন দেশকে বাধ্য করছে। সেই আমেরিকাই আবার মানবতা, গণতন্ত্র, মানবাধিকার নিয়ে বিশ্ববাসীকে জ্ঞান দান করতে চায়। গণচীনের মতো দেশকেও আমেরিকা মানবতা ও গণতন্ত্র শিা দেয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে। নোবেল বিজয়ী বিশ্বখ্যাত জার্মান কবি গুন্টারগ্রাস বলেছেন, যে দেশের কাছে আণবিক বোমা নেই, সেই দেশকে শায়েস্তা করার জন্য আমেরিকা ও তার বন্ধুরা উঠেপড়ে লেগেছে। আর যার কাছে আণবিক বোমা আছে, তার ব্যাপারে কারো কোনো কথা নেই। মারণাস্ত্র আছে বলে ইরাকের সাদ্দামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে শান্ত দেশটাকে লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে। সেখানে এখন প্রতিনিয়ত মানুষ মারা যাচ্ছে। একই অবস্থা করেছে লিবিয়ার। এখন বলছে, ইরান আক্রমণের জন্য আমেরিকা প্রস্তুত। বিশ্বজনমত আমেরিকা ও তার বন্ধুদের বিরুদ্ধে, কিন্তু মতা জনমতের বিরুদ্ধে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মুসলিম লীগ করেছেন, পরে আওয়ামী মুসলিম লীগ করেছেন। মুসলিম শব্দ বাদ দিয়ে শুধু আওয়ামী লীগ করেছেন। কিন্তু কিছুতেই তিনি আরাম পাচ্ছিলেন না। শেষ পর্যন্ত একদলীয় শাসনব্যবস্থা চালু করার জন্য বাকশাল করে সব দল নিষিদ্ধ করেছিলেন। অথচ গণতন্ত্রের জন্য তিনি বছরের পর বছর জেল-জুলুম-নির্যাতন সহ্য করেছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার সময় তিনি পাকিস্তানের কারাগারে ছিলেন। সারা জীবন আমেরিকাকে সমর্থন করে বাংলাদেশে ফিরে এসে ভারতের অনুপ্রেরণায় একদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। মওলানা ভাসানী যখন পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের কথা বললেন, বঙ্গবন্ধুর নেতা সোহরাওয়ার্দী সাহেব বললেন, ৯৮ ভাগ স্বায়ত্তশাসন দেয়া হয়ে গেছে। আর যারা স্বায়ত্তশাসনের দাবিদার ছিলেন, তাদের লাঠিপেটা করার জন্য ধেয়ে গেছে বঙ্গবন্ধুর ভক্তরা। পরে দেখা গেল, বঙ্গবন্ধু নিজেই পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসনের দাবিদার হয়ে গেছেন। ’৭০-৭১ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু কখনোই সমাজতন্ত্রের সমর্থক ছিলেন না। কিন্তু বাংলাদেশ হওয়ার পর তিনি হয়ে গেলেন সবচেয়ে বড় সমাজতান্ত্রিক নেতা। রাশিয়া হয়ে গেল তার সবচেয়ে বড় বন্ধু দেশ।
কেউ কেউ বলেন, দণি এশিয়ায় আওয়ামী লীগ হলো সবচেয়ে শক্তিশালী বিরোধী দল। মতায় গেলেও আওয়ামী লীগ নিজেকে বিরোধী দলই মনে করে। আওয়ামী নেতারা নিজেরাই বলেন, ‘মতায় থাকলেও আমরা রাজপথ ছাড়ি নাই।’ ফলে, আওয়ামী লীগের দলীয় ভাষা মতায় এবং মতার বাইরে একই সমান। 
লেখক : কবি ও সাংবাদিক
ershadmz40@yahoo.com